প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২২, ০৯:০০ পিএম
`আব্বু… যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাকো, বলতে চাই, তুমি চরম একটা ভুল পথে আছো। তুমি তোমার এই মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার এই মা’কে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃসংশতা, অন্যায় কাজে শামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি, তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবেন।
জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পর ছেলে আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকে একই পথে ঠেলে দিয়ে আট মাস ধরে তার দেখা না পেয়ে এভাবেই ছেলের প্রতি আকুতি জানাচ্ছিলেন মা আম্বিয়া সুলতানা এমিলি।
বুধবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বান্দরবানে পাহাড়ে অবস্থান নেয়া সন্তানের প্রতি বার্তা দেন এমিলি। এ সময়ে নিজে জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়া নিয়েও অনুশোচনা প্রকাশ করেন।
বিগত সময়ে নিরুদ্দেশ তরুণদের বিষয়ে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা নজরদারি করতে গিয়ে তথ্য পায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে আবু বক্কর ওরফে রিয়াসাদ রাইয়ান নামক এক তরুণ গত মার্চ মাসে নিরুদ্দেশ হয়। তার পরিবার সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করে। ইতিপূর্বে প্রকাশিত নিরুদ্দেশ ৫৫ জনের তালিকায় আবু বক্করের নাম রয়েছে।
গত ৩ নভেম্বর অভিযানে র্যাব সংগঠনের মহিলা শাখা সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং জানতে পারে যে, একজন মা উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়া তার সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে প্রেরণ করেছে।
র্যাব প্রাপ্ত তথ্যাদি বিশ্লেষণ ও নজরদারির মাধ্যমে নিজ সন্তানকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে প্রেরণের সঙ্গে জড়িত আম্বিয়া সুলতানা ওরফে এমিলিকে গত ৫ নভেম্বর উদ্ধার করে এবং তাকে পরিবারের সান্নিধ্যে রেখে গত ৪ দিন যাবত ডি-রেডিক্যালাইজেশন এর মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হয়।
র্যাব জানায়, ছেলের শিক্ষক আল-আমিনের মাধ্যমে তিনি ও তার ছেলে আবু বক্কর ২০২১ সালের প্রথম দিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করে। পরবর্তীতে আবু বক্কর ২০২২ সালের মার্চ মাসে আল আমিনের নির্দেশনায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তথাকথিত হিজরতের নামে বাড়ি থেকে বের হয় এবং সে আর বাড়িতে ফিরে আসেনি। অন্যান্য প্রশিক্ষণ শেষে গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে আল আমিনের নির্দেশনায় গ্রেফতারকৃত রনি পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য আবু বক্করকে বান্দরবানে দিয়ে আসে।
আম্বিয়া সুলতানা এমিলি তার ছেলে নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ ও অবস্থান সম্বন্ধে জানলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিকট তা গোপন এবং অবু বক্করের পিতা থানায় তার ছেলের নিখোঁজের জিডি করাসহ ছেলের সন্ধানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হন। আবু বক্কর পাহাড়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পর সন্তানের কোনো খোঁজ খবর না পেয়ে তিনি সন্তানের চিন্তায় হতবিহবল হয়ে পড়েন এবং ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনা করতে থাকেন। পরবর্তীতে র্যাব সদস্যরা তার সন্ধান পেলে সন্তানকে ফিরে পেতে ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
র্যাব গত ৪ দিন যাবত ডি-রেডিক্যালাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন মা এমিলি। নিজের সন্তানকে ফিরে পাওয়া ও নিজের ভুল স্বীকার করেন তিনি।
কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করা মেয়ে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে চাকরি করেছি। ২০১৩ সালে বিমান বাংলাদেশে চাকরি করেছি খণ্ডকালীন। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, চরম ভুল একটা পথকে সঠিক মনে করে সন্তানকে দিয়েছিলাম। এ কারণে আজকে আমার আদরের সন্তান বান্দরবানের পাহাড়ে অর্ধমৃত অবস্থায় আছে। আমি জানি না আমার সন্তান বেঁচে আছে কি না? জানি না আমি কখনো দেখতে পাবো কিনা? এটা আমার মা হিসেবে চরম ব্যর্থতা। শিক্ষিত মেয়ে হয়েও আমি বুঝতে পারিনি। আমার কোরআন হাদিসের দক্ষতা কম ছিল। আমি বুঝতে পারিনি সিঠিক কোনটা ভুল কোনটা। আমাকে ডি-মোটিভেটেড করা হয়েছে। আমার সন্তান আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ানকেও (১৫) করা হয়েছে। আমাকে মিসগাইড করা হয়েছে।
জঙ্গিদের গ্রুপ, সংগঠনের নাম, তাদের কর্মকাণ্ড সব কিছু আমার কাছে গোপন করা হয়েছিল। একটা ভুল বিষয়কে আমার সামনে কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো হয়েছে সঠিক হিসেবে।
আবু বক্কর রিয়াসাদ রাইয়ান আমার একমাত্র আদরের সন্তান অন্যান্য মায়ের মতোই। ও আমার কলিজার টুকরা। মেধাবী ছাত্র, বিনয়ী ছিল। দুষ্ট বাচ্চার জন্য মায়ের একটু কষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু আমার রিয়াসাদ রাইয়ান ছিল বিনয়ী, ভদ্র ও খুবই অবিডিয়েন্ট। বিপথে নেয়ার জন্য আমার মতো ছেলেদেরই টার্গেট করা হচ্ছে। যার শিকার আমি হয়েছি।
গত ৫ নভেম্বর র্যাবের যারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তারা খুবই সাবলিলভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বুঝিয়েছেন র্যাব সদস্যরা। আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তারা আমাকে বোঝার সুযোগ দিয়েছেন। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য কী, দেশের জন্য তারা কতটা ভয়ঙ্কর, দেশে যে তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, এসব কিছু এখন আমার কাছে পরিষ্কার। একজন মা কখনো চায় না তার আদরের সন্তান বিপথে চলে যাক। সন্তান যতই খারাপ হোক না কেন? মা কখনো তা চায় না। কিন্তু সন্তানসহ আমি ডিমটিভেড হয়ে গিয়েছিলাম।
আমার সন্তান চলতি বছরের ১৫ মার্চ ঘর থেকে বেড়িয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে তার শিক্ষক আল আমিন দেশের বাইরে ছিলেন। তিনি দেশে ফিরে যোগাযোগ করেন। আল আমিন আমাদের খুবই বিশ্বস্ত ছিল। ভদ্র বিনয়ী আল আমিন খুব ভালো পড়াতো বলে আমরা তাকে খুবই পছন্দ করতাম। সে-ই আমাদের ডিমোটিভেট করেছে। সে আমাদের কোরআন হাদিসের রেফান্সে দিয়ে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সে বলেছিল যে, প্রস্তুতি নিতে হবে, গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে তৈরি হয়ে থাকতে হবে।
আমি প্রথমে সন্তানকে বলতাম তোমার এসব শুনতে হবে না, তুমি পড়াশুনা করো।
রিয়াসাদ রাইয়ান সায়েন্সের ছাত্র ছিল। সে ছোট বেলা থেকেই বৃত্তি পাওয়া ছাত্র। শিশু একাডেমি থেকে সে পুরস্কার পেয়েছে। আল আমিন খুবই অল্প সময় কথা বলে আমার সন্তানকে আয়ত্বে নিয়েছে। আমিও ভুল বুঝে মেনে নিয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, আমার সন্তানকে প্রশিক্ষণে নিয়ে যাওয়া হবে, ভালো প্রশিক্ষণ, সে সব কিছু জানবে। সে দেখা করতে পারবে, সে যোগাযোগ করতে পারবে। সে বাসায় আসতে পারবে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
আমি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমি যে ভুল করেছি, আমার বুকটা যেভাবে খালি হয়েছে, সেই একই ভুল যেন কোনো বাবা-মা না করেন। আমি শিক্ষিত মেয়েও, শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। আমার খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে।
আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলতে চাই, আব্বু… যদি তুমি আমার ম্যাসেজ পেয়ে থাকো। তুমি চরম একটা ভুল পথে আছো। তুমি তোমার মাকে বিশ্বাস করতে পারো। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি যদি কখনো তোমার এই মাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি দেশের জন্য কোনো ধরনের হুমকির কাজ করবে না, কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৃসংতা, অন্যায় কাজে সামিল হবে না। আমি অনুরোধ করছি তুমি আত্মসমর্পণ করো। প্রশাসন সদয় হবেন।
জঙ্গিবাদে জড়ানো সন্তান রিয়াসাদ রাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে মা এমিলি বলেন, তোমার বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি খুবয় ভয় পেয়ে গেছি, যদি তার কিছু হয়ে যায়। তোমার নানা-নানী সবার অবস্থা খারাপ। তোমার কাক্কু, আত্মীয়-স্বজন সবাই পাগল প্রায়। আমি মা হিসেবে, তোমার বাবার জন্য চরম ব্যর্থতা হবে যদি তুমি বিশৃঙ্খলা করো, নৃসংস কিছু করো। তুমি তোমার বাবা-মাকে অপমানিত করো না। এই দেশে জন্ম নিয়ে তুমি অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছো।
মা হিসেবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে এমিলি বলেন, আমি শিক্ষিত মা হিসেবে অনুরোধ করছি, বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে সময় দিবেন, বুকে জড়িয়ে ধরবেন, ভেতরটা জানার চেষ্টা করবেন। ভালোবাসবেন। প্রতিদিন জানবেন। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, অবহেলা করবেন না। সে ছিটকে যেতে পারে যে কোনো সময়, তখন আমার মতো বুক ভাসিয়ে আর কোনো লাভ হবে না। সন্তানের মনটা বুঝুন। মা-বাবা যখন সত্যিকারের বন্ধু হতে পারে তখন সব কিছু শেয়ার করে, কাছে যেতে পারে। সন্তান হিসেবে অসহায় বোধ করবে না। বিপথে চলে যাবে না। সকল বাবা-মাকে বলছি, সংশোধন হোন, নইলে নিজেও ধ্বংস হয়ে যাবেন, জাতিও ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ করছি, আমাদের ছোট ছোট সন্তানেরা পাহাড়ে না খেয়ে কিভাবে আছে। ওরা তো ঘরেই ছিল, মায়ের বুকে ছিল। ওরা ওখানে কীভাবে বাঁচবে। ওরা নিজেও জানে না কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওদের ফিরিয়ে আনুন, ওদের সুযোগ দিন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, মায়ের বুকে ফিরে আসার। ওদের উদ্ধার করুন।
আইএ/এএল