প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২২, ০৯:২৭ পিএম
দেশে অ্যাপস ও বিভিন্ন সাইটের মাধ্যমে চলছে অনলাইন জুয়া বা বাজি খেলা। দেশীয় আইনে নিষিদ্ধ এই জুয়া খেলা চলছে অনেকটা প্রকাশ্যেই। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস শহর-নগর ছাড়িয়ে গ্রামেও চলছে দেদারছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে প্রকাশ্যে (সশরীরে) সংঘবদ্ধ জুয়া বা বাজি খেলার হার কমলেও অনলাইনে এই খেলার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এতে করেই তরুণদের একটা বড় অংশ জুয়ায় ধ্বংস হচ্ছে।
নিরবে-নিভৃতে সংঘবদ্ধ কাউকে ছাড়াই খেলতে পারা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকায় অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণরা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফুটবল, ক্রিকেট ও টেনিস খেলাসহ বিভিন্ন লীগ ম্যাচকে ঘিরে প্রতি মুহূর্তে বাজি ধরছে তরুণরা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা ভাগিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি চক্র।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি বলছে, দেশে পরিচালিত জুয়ার সাইটগুলোর পরিচালনাকারীরা বিদেশে অবস্থান করছে। তারা প্রথমে দেশের গুরুত্বর্পূণ এলাকাগুলোকে টার্গেট করে একেকটি চক্র গড়ে তোলে। এরপর ওই চক্র বিপদগামী তরুণেদের ভার্চ্যুয়ালি জুয়া খেলায় অল্প টাকা বিনিয়োগে বেশি টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। এইভাবেই প্রতিদিন অনলাইন জুয়া খেলায় দেড় থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হচ্ছে। যার পরিমাণ বছরে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাহিরে থাকা চক্রের মূল হোতাদের কাছে। সম্প্রতি অনলাইন জুয়া নিয়ে অনুসন্ধানে কোটি কোটি টাকা পাচার করা কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে সিআইডি। শীঘ্রই তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে সংস্থাটি।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, সঠিক নজরদারি না থাকায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতিদিনই কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাহিরে। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি তরুণ ও যুবকদের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। এই জন্য নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অবহেলাকেই দুষছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ডিজিটাল নিরাপত্তা সেলের নিয়মিত নজরদারির অংশ হিসেবে সম্প্রতি ৩৩১টি জুয়ার সাইট বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সার্চ ইঞ্জিন ‘গুগল’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ সাপেক্ষে অনলাইন জুয়া বা বাজি সংক্রান্ত ১৫০টি গুগল অ্যাপস বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে ইতোমধ্যে গুগল কর্তৃপক্ষ প্লে স্টোর থেকে ১৪টি অ্যাপস বন্ধ করেছে। অবশিষ্ট অ্যাপস বন্ধ করার জন্য যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
একইসঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিবের মাধ্যমে জুয়া খেলার ওয়েবসাইট ও গুগল অ্যাপসের প্রচার এবং অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়ায় এই ধরনের ২৭টি ফেসবুক লিংক এবং ৬৯টি ইউটিউব লিংক বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে ১৭টি ফেসবুক লিংক ও ১৭টি ইউটিউব লিংক বন্ধ করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট লিংকসমূহ বন্ধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিটিআরসির এক সূত্র জানায়, অ্যাপের নিয়ম অনুযায়ী খেলার চিপস কিনতে প্রয়োজন পড়ে নগদ অর্থ, ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড। ক্রেডিট বা ডেভিড কার্ড সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকে পড়েছে অনলাইন জুয়ার দিকে। কয়েকটি অপরাধী চক্র এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে। মোবাইল অ্যাপ ছাড়াও অপরাধীরা বিভিন্ন ওয়েবসাইট/ডোমেইনের মাধ্যমে সরাসরি অনলাইন গেইম/জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে এবং এ জন্য দেশে এবং বিদেশে হোস্টকৃত বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধন করা হয়। তারপর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য কার্ড বা অন্য কোনো মাধ্যমে জমা দিয়ে জুয়ায় অংশ নিতে হয়। অনলাইন জুয়াড়িরা বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা আদান-প্রদান করে থাকে।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী দেশে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অ্যাপসের মাধ্যমে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফুটবল, ক্রিকেট ও টেনিস খেলাসহ বিভিন্ন লিগ ম্যাচকে ঘিরে প্রতি মুহূর্তে অবৈধ অনলাইন জুয়া বা বাজি খেলা চলছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে প্রকাশ্যে এর হার কমলেও অনলাইনে এই খেলার প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং এতে আসক্ত হচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। রমরমা এ জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ এবং তাদের পরিবার। অনলাইনে জুয়া বা বাজির ওয়েবসাইটে বিটিআরসির এই মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং তা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এই বিষয়ে সিআইডি’র সাইবার ক্রাইম শাখার অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) কামরুল আহসান বলেন, সম্প্রীতি অনলাইন জুয়া খেলার নিয়ন্ত্রণকারীদের দেশীয় একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছি আমরা। তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। সেগুলো যাছাই বাছাই করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ওই চক্রটির সঙ্গে কারা কারা জড়িত সে সবের তথ্যও আমরা পেয়েছি। জড়িতদেরকে আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
অনলাইন জুয়ায় প্রতিদিন কি পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, ধারণা করছি প্রতিদিন দেড় থেকে দুই কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। যার বড় একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তথ্য প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহার মতে, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার ফলে ক্রমেই উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে অনলাইন জুয়ার আসক্তি। এতে একদিকে অর্থপাচারের কারণে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্ম বিপথে যাচ্ছে জানিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
তানভীর হাসান জোহা বলেন, কোথাও সংঘবদ্ধ হয়ে প্রকাশ্যে এখন আর কাউকে জুয়া খেলতে হয় না। বদ্ধ রুমে বসে যে কেউ কৌতূহলবসত জুয়ার সাইটগুলোতে ক্লিক করেই আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এই প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে কিশোর ও তরুণ বয়সীদের। যদিও সব বয়সীরাই এই জুয়া খেলার আসক্তিতে পড়তে পারে। কারণ সোস্যাল মিডিয়াতে এসব জুয়ার সাইটগুলোর বিষয়ে এমনভাবে প্রমোশন পোস্ট হয়, যে কেউ প্রলোভনে পড়বেই।
তিনি বলেন, দেশে বসে যারা জুয়া খেলে তাদের অধিকাংশই জানেন না তাদরে টাকাটা কিভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, লন্ডনে বসে কেউ একজন জুয়ার সাইট পরিচালনা করছে। সে তার এই সাইট পরিচালনার জন্য দেশে কয়েকজন এজেন্টকে কমিশনের বিনিময়ে কাজ দিলো। ওই এজেন্টরা জুয়া খেলোয়াড়দের কাছে নগদ টাকা গ্রহণ করে লন্ডনে থাকা ব্যক্তিকে দিয়ে ডলার সাবমিট করছে। এবার যখন জুয়াড়ি পাঁচ ডলারের বিনিময়ে বাজি ধরলো এবং সে বাজিতে জিতে ২০ ডলার পেলো। তখনও কিন্তু ওই এজেন্টরা ওই জুয়াড়িকে ডলারের বিনিময়ে নগদ টাকা সরবরাহ করছে। অন্যদিকে যেই দেশের ডলার সেই দেশে থেকে যাচ্ছে। এতে দেশে রেমিট্যান্সের উপর প্রভাব পড়ে।
তিনি আরও বলেন, এই প্রক্রিয়া ছাড়াও আরও একটি প্রক্রিয়া হলো- দেশীয় এজেন্টরা জুয়াড়িদের কাছ থেকে আদায় করা নগদ টাকাকে হুন্ডির মাধ্যমে কাজে লাগাচ্ছে। যা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও বেশি ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই যে প্রক্রিয়াগুলো ঘটছে, চাইলে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কিন্তু তাদের উদাসীনতার কারণে এসব নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না।
আইএ/এএল