• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ০৭ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

প্রতারণার আরেক কৌশল ‘তিমির বমি’

প্রকাশিত: নভেম্বর ৬, ২০২২, ১২:৫০ এএম

প্রতারণার আরেক কৌশল ‘তিমির বমি’

ইমরান আলী, ঢাকা

ব্রিটিশ কয়েন, ম্যাগেনেটিক পিলার, তক্ষকের পর প্রতারকরা এবার ‘তিমির বমি’ নিয়ে প্রতারণা শুরু করেছেন। রাজধানীর উত্তরা, ধানমন্ডি এবং গুলশান এলাকায় এ প্রতারক চক্র সক্রিয় রয়েছে। তিমির বমি কোটি কোটি টাকা মূল্য, সাগরে জেলেরা এটি পেয়েছে তাদের নিকট থেকে কম মূল্যে কিনে বেশি দামে বিক্রি করা যাবে এমন চটকদার কথা বলে টার্গেটকৃত লোককে আকৃষ্ট করাই এ প্রতারকদের লক্ষ্য।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের প্রতারকদের ব্যাপারে তারাও জেনেছেন। গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম এ প্রতারকদের গ্রেফতারে কাজও করছে।’

তিমির বমি কী : ফরাসি শব্দ অ্যাম্বার আর গ্রিস মিলে ইংরেজি অ্যাম্বারগ্রিস শব্দটি এসেছে। অবশ্য ‍‍`ফ্লোটিং গোল্ড: এ ন্যাচারাল অ্যান্ড (আনন্যাচারাল) হিস্ট্রি অব অ্যাম্বারগ্রিস‍‍` বইয়ের লেখক ক্রিস্টোফার কেমপ অ্যাম্বারগ্রিসকে তিমির বমি বলতে নারাজ। কারণ কোনো খাবার খাওয়ার পর হজম না হলে সাথে সাথে মুখ দিয়ে কোনো কিছু বের হলে তাকে বমি বলা হয়।

কিন্তু স্পার্ম তিমির পাকস্থলিতে অ্যাম্বারগ্রিস তৈরি হতে বছরের বেশি সময় লেগে যায়। স্পার্ম তিমি হাজার হাজার স্কুইড খায়। মাঝে মাঝে সেই স্কুইড পাকস্থলি ও অন্ত্রের মাঝখানে জায়গায় গিয়ে জমা হয়। আর সেটাই দীর্ঘদিন পর অ্যাম্বারগ্রিসে পরিণত হয়। পরে এক সময় স্পার্ম তিমি তা মুখ দিয়ে বের করে দেয়। অ্যাম্বারগ্রিস খানিকটা মোমের মতো পিচ্ছিল হয়।

তবে প্রথমে যখন তিমির মুখ থেকে বের হয় তখন সেটাতে কিছুটা বাজে গন্ধ থাকে। কিন্তু যখন তীরে আসার পর এটা আস্তে আস্তে শক্ত হয়, তখন এর দারুণ গন্ধ হয়। এজন্য সুগদ্ধি তৈরিতে ব্যাপক চাহিদা এই অ্যাম্বারগ্রিসের। বিশ্বের বিভিন্ন দামি সুগন্ধি ছাড়াও বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এই অ্যাম্বারগ্রিস।

সুগন্ধি তৈরিতে এর ব্যাপক চাহিদা থাকায় আর সহজলভ্য না হওয়ায় বাজারে অ্যাম্বারগ্রিসের অনেক দাম বলে জানা গেছে। এতো দামের কারণে একে ফ্লোটিং গোল্ড বা ভাসমান সোনাও বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এই ধারণাকে পূঁজি করেই তিমির বমি নিয়ে প্রতারণা শুরু হয়েছে। প্রকৃত তিমির বমির অনেক মূল্য কিন্তু প্রতারকরা নকল বমি নিয়েই প্রতারণা করে থাকেন। রাজধানীসহ সারাদেশে মুদ্রা, ম্যাগনেটিক পিলার এমনকি তক্ষক নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রতারণা হয়ে থাকে। থানা পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব, সিআইডির হাতে আটক হওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, গুলিস্থান থেকে এক ধরনের ধাতব মুদ্রা তৈরী করে প্রতারক চক্র। আর এ মুদ্রা তৈরী করতে খরচ হয় একশ’ টাকারও কম। আর এ মুদ্রাকে শতকোটি বলে বিভিন্ন মানুষের নিকট থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে আত্নসাৎ করে। একই কায়দায় ম্যাগনেটিক পিলার নিয়েও প্রতারণা করে থাকে।

সূত্র জানায়, প্রতারকরা নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। নতুন করে একটি চক্র কুমিরের বমি নিয়ে প্রতারণা শুরু করেছে। রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা এবং গুলশান এলাকায় এ প্রতারক চক্রের বেশিরভাগ অবস্থান।

দামী দামী রেষ্টুরেন্টে বসেন টাকা পয়সা আছে এমন বিত্তশালী লোকদের তারা টার্গেট করেন। এরপর তারা তাদের কৌশল অবলম্বন করে অফার করে থাকে। প্রতারক চক্রের সদস্যরা নিজেরাই সবকিছু সাজে। এমনকি ভুয়াভাবে মেডিকেল অফিসারও সাজানো থাকে।

সূত্র জানায়, সাগরে জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে এটি পেয়েছে। জেলেরা অশিক্ষিত বিক্রির জায়গা নেই অল্প দাম হলে নেয়া যাবে। আর এটি হাতে নিতে পারলে কোটি কোটি টাকা বলে প্রলোভন দেখানো হয়। আর একবার লোভে পড়লেই সর্বনাশ। টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার পাল্টে ফেলে।

জানা যায়, এটি যেহেতু অবৈধকাজ সেহেতু এটি দ্বারা প্রতারিত হলেও সহজেই মানুষ স্বীকারও করেনা। টাকার পরিমান বেশি হলে অনেক সময় ভুক্তভোগীরা থানা অথবা গোয়েন্দা পুলিশে অভিযোগ করে থাকেন।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, এ ধরনের প্রতারক চক্র রাজধানীতে রয়েছে। এরাই কখনো কয়েন, পিলার এমনকি তক্ষক দিয়েও প্রতারণা করে থাকে। টার্গেটকৃত ব্যক্তির টাকা পয়সার ওপর নির্ভর করে প্রতারণার জাল তৈরী করে। তারা এমনভাবেই এ প্রতারণা করে টার্গেটকৃত ব্যক্তি কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারেনা। তাদের চলাফেরাও নামি দামি হোটেল রেষ্টুরেন্টে।

কয়েন, পিলার কিংবা তিমির বমি এগুলো পরীক্ষার জন্য আবার নিজেদের লোকই সেট করা থাকে। তারা এমনভাবেই পরীক্ষা করে টার্গেটকৃত ব্যক্তি নিসঙ্কচে বিশ্বাস স্থাপন করে। এভাবেই টার্গেটকৃত ব্যক্তির নিকট থেকে টাকা হাতিয়ে তারা কৌশলে সটকে পড়ে।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, টার্গেটকৃত ব্যক্তি যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন তখন তার আর করার কিছু থাকেনা। তিনি যেহেতু জেনে শুনে অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন এ কারণে পুলিশের নিকট আসতেও ভয় পান।

উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা অতি সম্প্রতি কয়েন ও পিলার প্রতারক চক্রকে গ্রেফতার করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে তারাও এ ধরনের তথ্য দিয়েছে। আসলে এগুলো বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করলে প্রতারকদের গ্রেফতারে সহজ হয়। কিন্তু অনেক সময় অভিযোগকারী পাওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘প্রতারিত হয় কখন যখন লোভ সংবরণ করতে পারেনা। যখন কেউ এ ধরনের লোভ লালসা দেখাবে তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ পুলিশের এ কর্মকর্তার।’

 

 আইএ/এআরআই

আর্কাইভ