প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২২, ১০:০৯ পিএম
দেশে প্রতি বছর গড়ে অন্তত ২০ হাজার মানুষ সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই নারী। প্রযুক্তি সম্পর্কে না বোঝা কিংবা উদ্দেশ্যে প্রনোদিতভাবে ঘটছে এ অপরাধগুলো।
পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ২০ হাজারেরও বেশি নারী হয়রানির শিকার হয়েছেন। আর চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত হয়রানির শিকার হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার মানুষ। ২০২১ সালে পুলিশ সদরদপ্তরের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন (পিসিএসডব্লিউ) উইংয়ে ১২ হাজারের ও বেশি অভিযোগ এসেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। তারা বলছেন, অনেকেই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে ভালো জানেন না। আবার অনেকে জেনে বুঝে সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছেন। এই কারণে অনেকে এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন। প্রযুক্তি ব্যবহারে সবাইকে সতর্ক না হলে অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
পুলিশ সূত্র বলছে, দেশের সব থানায় সাইবার সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসছে এবং এসব বিষয় নিয়ে মামলাও হচ্ছে। এসব মামলার দ্রুত তদন্ত করতে প্রতিটি থানায় পর্যায়ক্রমে সাইবার বিভাগ চালু করা হলেও যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। এজন্য নতুন করে সারা দেশে সাইবার নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে পুলিশের বিশেষ শাখা।
সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাইবার অপরাধ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সাইবার অপরাধ সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অপরাধ মোকাবিলার সঙ্গে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। সাইবার অপরাধের প্রাথমিক বিষয় নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতামূলক কাউন্সেলিং করতে পারলে এসব অপরাধ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন হয়রানির হার ছিল ৭ দশমিক ৬৯ ভাগ, আপত্তিকর ছবি ৫ দশমিক ৮৫ ভাগ, সাইবার বুলিং ৫০ দশমিক ১৬ ভাগ এবং ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যৌন হয়রানির হার হচ্ছে ৯ দশমিক ৩৪ ভাগ, আপত্তিকর মেসেজ ৬ দশমিক ৯০ ভাগ এবং সাইবার বুলিংয়ের হার ৫০ দশমিক ২৭ ভাগ।
২০২১ সালে ওয়েবসাইট/ডোমেইন থেকে লিংক অপসারণের অনুরোধ করা হয়েছে ১ হাজার ২৩৫টি। এর মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২৩৫টি, অপসারণের হার ১০০ ভাগ। ২০২২ সালে ওয়েবসাইট/ডোমেইন থেকে লিংক অপসারণের অনুরোধ করা হয়েছে ৬৪৫টি। এর মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে ৬৪৫টি, অপসারণের হার ১০০ ভাগ।
এদিকে বিটিআরসি বলছে, ২০২১ সালে ফেসবুক থেকে ৮ হাজার ৯১৬টি এবং ২০২২ সালে ৮ হাজার ২২৮টি লিংক অপসারিত হয়েছে। ২০২১ সালে ইউটিউব থেকে ১ হাজার ১৩টি এবং ২০২২ সালে অপসারিত হয়েছে ২২২টি লিংক। ২০২২ সালে টিকটক থেকে অপসারিত হয়েছে ১ হাজার ১৫৯টি লিংক, ২০২২ সালে বিগো, লাইকি ও ইমো থেকে অপসারিত হয়েছে ৬৭টি এবং টুইটার থেকে অপসারিত হয়েছে ২৯টি লিংক।
এসব বিষয় নিয়ে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামীতে সক্ষম ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে নিজস্ব প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।
দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করছেন এমন কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে সাইবার অপরাধ বাড়ছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছর ২০২২ সালের এ পর্যন্ত নারীদের তুলনায় পুরুষেরা সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন বেশি। তবে বছর শেষ না হওয়ায় এর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে জানায়নি সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
সাইবার অপরাধ বিভাগ বলছে, সবাই সচেতন না হলে সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে মানুষ নিরাপত্তা ও আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হ্যাকিং, কপিরাইট লঙ্ঘন, শিশু পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধগুলো বর্তমানে উচ্চমাত্রায় বেড়ে চলেছে বলে মনে করছেন সাইবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা।
সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, কোনো কারণে যদি কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হন, তাহলে বিষয়টি নজরে আসা মাত্রই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করতে হবে। প্রয়োজনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। অথবা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনেও (বিটিআরসি) লিখিতভাবে জানিয়ে রাখতে হবে। এতে করে কেউ মিথ্যাভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে অনেকটা সুরক্ষা পওয়া যাবে।
অবশ্য অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের পর খুব কম সময়েই অনেকের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এর সূত্র ধরেই সামান্য ভুলের কারণে বিভিন্ন জটিলতায় পড়তে হচ্ছে নেটিজেনদেরকে।
পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের একটি মামলার বিবরণ তুলে ধরে মামলার তদন্তকারী এক কর্মকর্তা বলেন, এক নারী (অপরাধী) প্রায়ই ভিকটিমের সঙ্গে একে অপরের নিজেদের বেশ কিছু ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও শেয়ার করতেন। এক পর্যায়ে তারা দুই জন প্রাইভেট ভিডিও চ্যাটে যুক্ত হন। পরে ওই নারী ওই পুরুষের কাছে বেশ মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। ওই পুরুষ বেশ কিছু টাকা দিয়েও দেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এখানেই শেষ নয় এক পর্যায়ে কৌশলে ওই নারী ওই পুরুষের পরিবার ও ব্যক্তিগত কয়েকজনের মোবাইল নম্বর নেন। ২-৩ মাস পরে আবারও ওই নারী তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেন এবং মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। এরপর সেই পুরুষ পুলিশের সাইবার ইউনিটে এসে একটি অভিযোগ দায়ের করেন এবং সেই অনুযায়ী সাইবার ইউনিট এ ঘটনার তদন্ত করে ওই নারীকে আটক করে।
সাইবার ইউনিটের বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারী ও পুরুষ উভয়েই সাইবার অপরাধের শিকার হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর শিকার পুরুষরা। এদের বেশির ভাগই মোটামুটি ধনী, বিবাহিত এবং মধ্য বয়সী।
কর্মকর্তারা বলছেন, যে সব মেয়েরা সাইবার অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তারা অধিকাংশ স্বামী-সংসার বিহীন এবং তাদের চলাফেরা এলোমেলো। অনেকে আবার ইয়াবা, আইস বা অন্যান্য মাদকের সঙ্গেও যুক্ত।
এ বিষয়ে সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কামিশনার (এডিসি) নাজমুল বলেন, কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। তাতে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
পুলিশ বলছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্ল্যাকমেইলিং, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ, প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে যৌন হয়রানির মত ঘটনা ঘটছে। ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টিকটক ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধের জন্য প্রায় ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাইবার অপরাধ বাড়ছে জানিয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার এসপি মুক্তা ধর বলেন, এসব অপরাধের বেশিরভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে উন্নত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে অপরাধগুলো এখন আরও বড় আকারে সংঘটিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এদের নজরে না রাখলে এসব অপরাধ দিনদিন বেড়েই চলবে।
আইএ