প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২২, ০৮:০৮ পিএম
২০১৭ সালে হলিউড থেকে শুরু হওয়া হ্যাশট্যাগ মি-টু আন্দোলন শুরুর পরপরই আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। কর্মক্ষেত্রে বা অন্য যে কোনো জায়গায় ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের হাতে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঘটনা যা বছরের পর বছর চেপে রাখা হয়েছিল, তা প্রকাশ করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল ব্যাপার।
নারীদের মধ্যে মি-টু এতটাই সাড়া ফেলে যে পশ্চিমা সমাজ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষণশীল সমাজেও বহু বছর চেপে রাখা নিপীড়নের গল্প একে একে উঠে আসে। বহু বিখ্যাত মানুষ-প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, নামজাদা শিল্পীর বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। পাঁচ বছর পর মি-টু জোয়ারের তোড় কমেছে, কিন্তু মি-টু`র নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে দেশে দেশে।
যুক্তরাষ্ট্রে মি-টু আন্দোলন শুরুর এক বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশে প্রথম মি-টু অভিযোগ ওঠে। বিদেশে বসবাসকারী দুইজন বাংলাদেশি নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করে ফেসবুক পোস্ট দেয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়। সেটাকেই বাংলাদেশে মি-টু আন্দোলনের শুরু বলা হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের শেষের দিকে দেশের ভেতরে নানাভাবে যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়ার আরও বেশ কয়েকটি ঘটনা আলোচনায় উঠে আসে।
শুরুর দিকের অভিযোগগুলো নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও লেখালেখি হয়েছিল। সে সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদন্তের কথা বলা হয় এবং নারী অধিকারকর্মীরাও সেসময় বেশকিছু কর্মসূচি নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও, সেইসব অভিযোগের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কিংবা আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে আলোচনা নেই। বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন মানুষেরা মনে করেন, বাংলাদেশে মি-টু তেমন আলোড়ন বা সাড়া জাগাতে পারেনি।
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তামান্না সুলতানা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘মূলত মি-টু আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৯ সালে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে শৈশবে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ করেছিলাম। নিজের একজন প্রভাবশালী আত্মীয়ের কাছে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছিলাম আমি। ঘটনা প্রকাশের পর যেহেতু আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করিনি, ফলে কোনো মামলা হয়নি। কিন্তু আশা করেছিলাম, অন্তত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার পরিবার এবং চেনা মানুষেরা দাঁড়াবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু ঘটনা হয়েছিল একেবারে বিপরীত। পরিবারের লোকেরা আমাকেই দোষারোপ করেছিল `কেন আমি ওই লোকের কাছে গিয়েছিলাম`, `কেন ঘটনা গোপন রেখেছিলাম` এবং `অত ছোটবেলার কথা আসলেই আমার ঠিক ঠিক মনে আছে কিনা` অর্থাৎ আমি সত্য কথা বলছি কিনা।’
তামান্না সুলতানা আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘মি-টু মাধ্যমে যৌন নিগ্রহ বন্ধ হবে কি, আমি উল্টো পরিবার এবং চেনা মানুষের মধ্যে নানা ধরণের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছি, আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলা হয়েছে এবং আমাকে এক্সটেন্ডেড পরিবারের মানুষেরা এক রকম বয়কট করেছেন।’
এ বিষয়ে নারী অধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘বাংলাদেশে মি-টু আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে যারাই মি-টু ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে নিজেদের ওপর ঘটা নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করেছেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকে নানাভাবে অপবাদের শিকার হতে হয়েছে, তাদের নিয়ে বিদ্রূপ করা হয়েছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের একেবারে কোণঠাসা করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রভাবশালী বা যারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ্যে আনাটা ছিল মি-টুর প্রধান ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশে যারাই অভিযোগ করেছে তাদের নানাভাবে হেনস্তা করে কোণঠাসা করা হয়েছে। সেই কারণেই পরবর্তীতে অনেকে নিজের নিপীড়নের কথা প্রকাশ করতে আগ্রহী হননি। এ ছাড়া যারা অভিযোগ তুলেছেন, তারা অনেকেই মানহানি বা অনলাইন-অফলাইনে ট্রলের শিকার হয়েছেন, সেটি সহ্য করার ক্ষমতাও সবার থাকে না। যে কারণে অনেকে পিছিয়ে গেছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘যেসব অভিযোগ উঠেছিল তার কোনো একটিরও যদি ব্যবস্থা নেয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যেত তাহলে সেটি অন্যদের উৎসাহিত করতো। যেমন হলিউডের প্রযোজক হার্ভি ওয়েনস্টেইনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার নজির যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে। তিনি এখনও বন্দিজীবন যাপন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তেমনটা দেখা যায়নি।’
অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘বাংলাদেশের সমাজ এখনও অনেক রক্ষণশীল এবং পিতৃতান্ত্রিক। ফলে নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে এখনও বেশিরভাগ সেটি প্রকাশ্যে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না সমাজের বড় অংশের মানুষ। এ ছাড়া রক্ষণশীল সমাজে সাধারণত নারী নিজের ওপর ঘটনা নিগ্রহের বাইরে প্রকাশ করে বিচার চাইবে এটা অনেকে মেনে নেন না। ফলে মি-টুতে নারীদের করা অভিযোগকে সমাজে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি, যার প্রভাবে এই আন্দোলন জোরালো হতে পারেনি।’
মি-টু মিডিয়ার `যথেষ্ট` সমর্থন পায়নি বলেও মনে করেন অনেকে। এ ছাড়া বাংলাদেশে নারী সংগঠন শক্তিশালী না হওয়ার কারণে মি-টু আন্দোলন সফল হয়নি বা সমাজে বড় চাপ তৈরি করতে পারেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
খুশী কবির বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বা ভারতে মি-টু আন্দোলনের যে ফল দেখা গেছে তার পেছনে ওই দেশগুলোর নারী সংগঠনগুলো ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি জোরালো ছিল না।’
বাংলাদেশে মি-টু আন্দোলন পুরোপুরি সাড়া জাগাতে না পারলেও বেশ ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে বলে অনেকে মনে করেন।
খুশী কবির মনে করেন, মি-টু আন্দোলনের আরেকটা বিষয়টা ছিল মেয়েরা যেন সাহস করে বলতে পারে, সেটা এখন অনেকেই বলছেন। নারীরা বিশেষত শিক্ষিত নারীদের মধ্যে এখন নিজের সঙ্গে ঘটা যৌন সহিংসতার ঘটনা লুকিয়ে না রেখে প্রকাশের প্রবণতা বেড়েছে। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বা যৌন সহিংসতার নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগে কর্মক্ষেত্রে যেসব আচরণ সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য ভাবা হতো, বা সহনীয় ভাবা হতো, সেটি এখন দেখা যায় না।’
পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনের কর্মকর্তারা বলেছেন, কেবল সরাসরি যৌন হয়রানি নয়, সাইবার হয়রানির শিকার হয়েও নারীদের অভিযোগ জানানোর হার বেড়েছে।