• ঢাকা শুক্রবার
    ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সড়ক নিরাপত্তায় গলার কাঁটা বাস লাভার চক্র

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২, ১২:১৬ এএম

সড়ক নিরাপত্তায় গলার কাঁটা বাস লাভার চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায় গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে বাসের ধাক্কায় একটি মালবাহী ট্রাক উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে চালক -হেল্পারসহ আহত হন দুজন। অপরদিকে ধাক্কা দেয়া বাসটির যাত্রীরা আহত হলেও ঘটনাস্থল থেকে বাসটিকে চম্পট দিতে দেখা যায়।

এ ঘটনা কোনো পত্র-পত্রিকার সংবাদের শিরোনাম না হলেও এই দুর্ঘটনার পিছনে বেরিয়ে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া দুর্ঘটনার ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রাকে ধাক্কা দেয়া হানিফ পরিবহনের ওই বাসটি খুব বেপরোয়া গতিতে চলছিলো। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পিছনে থাকা অপর আরেকটি ইমাদ পরিবহনের বাস থেকে ধারণ করা ভিডিও দেখে জানা যায়, উভয় বাসই দুর্ঘটনার সময় প্রতিযোগিতা করছিলো। দুটি বাসকেই এই প্রতিযোগিতায় উস্কে দিয়ে তারা ভিডিও ধারণ করছিলো তথাকথিত বাস লাভার নামে একটি চক্র। শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করতে না নেমে উলটো ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়ার কথা তুললেন প্রত্যক্ষ ওই চালকসহ সংঘবদ্ধ চক্রটি যা ভিডিওতে উঠে আসে। এমনকি দুর্ঘটনার ওই ফুটেজটি সরিয়ে ফেলারও নির্দেশ দেয় তারা।

সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মধ্যে মূলত ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ, টিকটক এবং পেইজ কেন্দ্রিক ভাবে চলে বাস লাভিং কার্যক্রম। বাসের ছবি বা ভিডিও ধারণ করে থাকে তারা। সেগুলো আপলোড করছে বিভিন্ন গ্রুপে এবং পেইজে। কিন্তু এই বাস লাভারদের মধ্যেই রয়েছে একটি দল যারা এক ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। চালকদের উস্কে দিয়ে বেপরোয়া গতিতে চালাতে উদ্বুদ্ধ করাই যাদের মূলমন্ত্র।

শুধু এই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতেই নয়। সামাজিক মাধ্যম টিকটক ও ফেসবুকের বাস লাভার কমিউনিটি গ্রুপগুলোতে এ ধরণের ভিডিও প্রচার হয়ে আসছিল বহুদিন ধরেই। সাধারণত দেখা যায়, গতিশীল যাত্রীবাহী বাস বেপরোয়াভাবে অন্য বাসকে ওভারটেক করছে। চালকদের উস্কে দেওয়া একটি ভিডিওতে ক্যাপশনে লিখা ছিল, ‘নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো ফেয়ার রেস, শুধুমাত্র নিজেদের মজার জন্যই করা’ এ ছাড়াও ‘ওটি দিয়ে খায়ে দিবো’ যার অর্থ আক্রোশের সাথে ওভারটেক করে পিছে ফেলে দেয়া- এ ধরণের ক্যাপশন যোগ করা হয়।

এ ছাড়াও ভিডিওগুলোতে রাতের বেলা হেডলাইট বন্ধ করে ওভারটেক করার মতও ভয়ংকর দৃশ্যও চোখে পড়ে, যা ঘটাতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। এতে চালক, যাত্রীসহ এমনকি পথচারীদের থাকছে মৃত্যু ঝুঁকি। যেখানে সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে চক্রটি।

সরকার ‘যত গতি তত ক্ষতি’স্লোগানে সড়কে সকল চালকদের প্রতি যেমন সতর্কবার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে বাস লাভাররা যানবাহনের উচ্চগতির ভিডিও মোবাইলে ধারণ করে তা সামাজিকমাধ্যম গুলোতে ছড়িয়ে বাস চালকদের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতামূলক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে যেমন বাড়বে সড়কে দুর্ঘটনা, অন্যদিকে ঘটানো হচ্ছে সড়ক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন।

এদিকে বাস লাভারদের দাবি,  যে চালক যত গতিতে ও বেপরোয়াভাবে চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেই উপযুক্ত চালক। মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসের উচ্চ গতির বেপরোয়াভাবে বাস চালনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছেড়ে এমনটাই প্রকাশ করছে তারা। এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বিভিন্ন বাস চালকেরা। সামাজিক মাধ্যমে তাদের মধ্যে বেপরোয়াভাবে চালানোর আক্ষেপ দেখা গেলেও তা সরাসরি স্বীকার করতে চায়নি কোনো বাস চালকই।

বিষয়টিকে বাস লাভার কমিউনিটি বাস চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক প্রতিক্রিয়া কেন ছুড়ে দিচ্ছে তা জানতে আলোচনা করা হয় একজন বাস লাভারের সাথে। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি জানান, ‘বাস লাভিং আগে এমনটা ছিলো না। ইদানিং এ দলের মধ্যে একটি গ্রুপ চলে এসেছে যারা একধরণের বেপরোয়া গতিকে প্রমোট করছে।  তারা মনে করে, যে যত গতিতে চালিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেই উপযুক্ত চালক। কিন্তু সমস্যা হলো, যে জোরে চালাতে পারে না, ওভারটেক খায়, তাকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রল বা অপমান করা হয়। ট্রল করে ওসব চক্রেরই সদস্যরা। এতে করে চালকদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ প্রকাশ হতে দেখা যায়। এতে করে তারাও চেষ্টা করে বেপরোয়া গতির দিকে ঝুঁকে যাওয়ার। তবে এগুলো রাতের ট্যুরের বাসগুলোতে বেশি করা হয়ে থাকে। ট্রিপের যাত্রীবাহী বাসেও করা হয় অনেক সময়।’

এদিকে বাস লাভারদের এ ধরণের কর্মকান্ড যাত্রী-পথচারীদের প্রাণহানির কারণ হতে পারে এবং এটি অপরাধ, তা মানতে নারাজ বাস লাভার কমিউনিটি। এ বিষয়ে তারা জানান, বাস লাভাররা এ ধরণের কার্যক্রম দক্ষ চালকদের দিয়ে করিয়ে থাকে। তারা অনেক বছরের অভিজ্ঞ চালক। এছাড়া তাদের দাবি, এখনও পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি যেখানে বাস লাভারদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এছাড়াও বাস লাভার কমিউনিটি আরও জানায়, তারা এ সমস্ত চালকদের আলাদা একটা নামে ডাকেন। যেমন বাউলি জসিম, যিনি বাস নিয়ে মাঝ রাস্তায় বাউলি দেন অর্থাৎ রাস্তার এপাশ ওপাশ করে থাকেন। এছাড়াও আছে, হেডফোন আজিজ। যিনি কানে হেডফোন লাগিয়ে যাত্রীবাহী বাস চালান। এছাড়াও তারকাটা জনি, রকেট সোহেল, কুত্তা বাহার এসকল নামও উঠে আসে বাস লাভারদের কাছ থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তারা দেশের বিভিন্ন বড় বড় অপারেটরের বাস চালক তারা। তাদের প্রকৃত নামের সাথে পদবি লাগিয়ে তাদের বাস চালানোর প্রকৃতি বহন করে বলে দাবি করে এ কমিউনিটি। এমন দাবির প্রেক্ষিতে কথিত বাউলি জসিম এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ধরণের কাজের সাথে জড়িত থাকেনি বলে অস্বীকার করেন। ঢাকা-খাগড়াছড়ি রুটে শ্যামলি পরিবহনের গাড়ী চালান তিনি।

দেশের সড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা কেমন তা সার্বিক সময়ের বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখলেই উঠে আসে। সড়কে কোনোভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না বিশৃঙ্খলা। পরিসংখ্যান বলছে দুর্ঘটনা ও সড়কে প্রাণহানির সারিতে শীর্ষে রয়েছে বাস।

দুর্ঘটনা রোধ বিষয়ক সংস্থা ‍‍`সেভ দ্যা রোড‍‍` এর প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,  গত আগস্ট মাসেই ৮৯৬ টি বাসদুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছেন ২৫৫ জন এবং আহত হয়েছেন ৯১৮ জন।  অর্থাৎ গড়ে একদিনে ৮ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে শুধু বাস দুর্ঘটনায়।

বিশেষজ্ঞরা এখন পর্যন্ত মনে করতেন, মহাসড়ক ঘিরে গড়ে ওঠা হাটবাজার, শিল্পকারখানা, যা দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ। এছাড়াও নিষিদ্ধ থ্রি-হুইলারসহ অন্যান্য ছোট যান বাহনও রয়েছে এ তালিকায়। উল্টো পথে যানবাহন চলাচলের কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে, প্রাণহানি হচ্ছে। অথচ উল্লেখিত সমস্যাগুলো শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সীমাবদ্ধ, তা নয়।

গতির নেশায় মাতিয়ে ওঠা কথিত বাস লাভার নামে এই উশৃংখল চক্র এ সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে যেমন দুর্ঘটনার ব্যাপকতা বাড়িয়ে দেওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি করছে, তেমনিভাবে সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা আরও অনিশ্চিত করে তুলছে- মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদকের সাথে আলোচনা করেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি জানান, ‍‍`এ ধরণের কর্মকাণ্ড অবশ্যই দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। সড়কে এত বেশি দুর্ঘটনার কান্না, তার মধ্যে এ বিষয়টি এতদিন পর্যন্ত আমাদের কানে আসেনি। অথচ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোস্যাল মিডিয়াগুলোতে এর যেমন প্রভাব বিস্তার করছে, একইসঙ্গে টিকটকের মাধ্যমে গণপরিবহণকে বা চালককে ব্যবহার করা অত্যন্ত মারাত্মক বিষয়। যেটা সড়ক নিরাপত্তায় অত্যন্ত ঝুকি বহন করে। সুতরাং, এ বিষয়গুলো নিয়ে আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী যারা আছেন, তাদের এ বিষয়গুলি সম্পর্কে অবগত থাকা দরকার, নজরদারি বাড়ানোর দরকার। এ ধরণের  ভিডিওগুলো যেসব আইডি বা পেজ থেকে ছাড়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।‍‍`

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর পরিচালক অধ্যাপক ড. এম হাদিউজ্জামান বলেন, ‍‍`চালককে অমনোযোগী করে তোলা একটি ভয়ানক অপরাধ। সেক্ষেত্রে টিকটককে ব্যবহার করে চালককে উস্কে দিয়ে ওভারস্পিডিং এর ভিডিও ধারণের ঘটনা যেহেতু গণপরিবহনের মত বাহনের সাথে ঘটছে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তাতে হতাহত বা প্রাণহানি ব্যাপক আকারে ধারণ করতে পারে। আমরা ওভারস্পিডিংকে সবসময় প্রাণনাশের হাতিয়ার হিসেবেই চিহ্নিত করেছি। প্রথমত সেখানে ওভারস্পিডিংকে উস্কে দিচ্ছে, দ্বিতীয়ত সড়ক পরিবহন আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন আইনে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান আছে। এটা হাইওয়ে পুলিশের মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। চালকদের মাঝে ওভারস্পিডিংয়ের প্রবণতা তো আছেই, এছাড়া এই ওভারস্পিডিং এর পিছনে চালক ছাড়া অন্যকেউ সম্পৃক্ত আছে কিনা তা নিশ্চিত করা যাবে যানবাহনে সিসিটিভি ক্যামেরা যুক্ত করার মাধ্যমে।‍‍`

এছাড়াও যখনই টিকটকার বা বাস লাভাররা চালকদের উস্কে ভিডিও ধারণ করবে, তখন যাত্রীরা ৯৯৯ এ কলের মাধ্যমে তাৎক্ষনিকভাবে অভিযোগ জানাবে- এমন পরামর্শ দেন এই গবেষক। 

তবে বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী বরাবরের মতই এ সকল সমস্যা সমাধানের দায়বদ্ধতা থেকে যাচ্ছে হাইওয়ে প্রশাসনের প্রতি। প্রশাসন চাইলেই এ ধরণের সমস্যাকে সহজেই সমাধান দিতে পারেন বলে মনে করছেন অনেকেই।

মহাসড়কে চালককে উস্কে দেওয়ার প্রসঙ্গে দাউদকান্দি হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মাদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, মহাসড়কে বেপরোয়া গতির বিরুদ্ধে হাইওয়ে পুলিশ সবসময় তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, ‍‍`চালককে ওভারস্পিডিংয়ে কেউ সহযোগীতা করে কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখবো। এ জন্য আমরা নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি। প্রয়োজনে বাস থামিয়ে এর অভ্যন্তরে চেক করা হবে কেউ এ ধরণের কাজ করছে কিনা। তবে উস্কে দেওয়া ওইসব ভিডিওধারীরা বাসে ওঠা মাত্রই ড্রাইভার বা যাত্রী আমাদের বিষয়টি জানানোর মাধ্যমে সহায়তা করতে পারেন। আমরা মহাসড়কে শৃঙখলা আনতে ইতোমধ্যে কঠোর তৎপরতা রাখছি। অতি দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে।‍‍`

 

এআরআই

জাতীয় সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ