
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২২, ১২:২৩ এএম
যত
ট্রিপ, তত টাকা। এমনটাই মনে ধারণ করেন যাত্রী পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। তাই তো প্রায়
সময়ই সড়কে দেখা যায় বিশৃঙ্খলা। এমনকি মানেন না কেউ সড়ক আইন। আর এতে অনেক সময় ঘটে যায়
দুর্ঘটনাও। দৃশ্যটা সারা বাংলাদেশেরই। উৎসবের ছুটির সময় দেখা যায় দূরপাল্লার বাসগুলোর
চালক ও হেল্পারদের ন্যূনতম নিদ্রার সময়টুকুও দেওয়া হয় না। ফলে যানজটে আটকে থাকা সময়ে
কিছুটা ঘুম সেরে নেন তারা। আর রাজধানীতে তো এই দৃশ্য প্রতিদিনকার। বাসগুলোতে দেখা
যায়, যানজটে পড়লে অনেক সময়ই স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে ঘুমান তারা। অনেকটা ক্লান্ত
থাকার কারণে এমনটা করতে বাধ্য হন তারা। কিন্তু প্রশ্নটা উঠে সেখানেই, ক্লান্ত দেহে
পরিবহন চালানো কতটা নিরাপদ যাত্রীদের জন্য।
বুধবার
(১৭ আগস্ট) রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকায় যানজটের দীর্ঘলাইন দেখা যায়। বাইরে জুম বৃষ্টি,
আবহাওয়া কিছুটা ঠাণ্ডা। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি। অনেকটা ক্লান্ত ছিলেন বাস ড্রাইভার
রফিকুল (ছদ্মনাম)। তাই দীর্ঘ যানজট দেখে স্টেয়ারিং হুইলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
যানজটে থাকা পুরো সময়টা ধরেই ঘুমান তিনি। পরবর্তীতে সিগন্যাল ছাড়ার পর হেল্পারের ডাকে
ঘুম থেকে উঠে স্টিয়ারিং ধরেন তিনি। চেহারায় তখন তার অনেকটা ক্লান্তির চাপ। সঙ্গে বিরক্তির
চাপও আছে, যদি আরেকটু ঘুমানো যেত।
মনিরুজ্জামান
নামক এক বাসযাত্রী বলেন, ‘ক্লান্ত দেহ নিয়ে তারা বাস চালাচ্ছে। চালকের দিকে তাকালে
মনে হয় তিনি ঘুমাচ্ছেন না অনেকদিন। মাঝে-মাঝে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, আবার ব্রেকও
করছেন। ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এভাবে ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাস চালালে
তাদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হবে। ফলে যে কোনো সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
সেই
বাসচালক জানান, অনেকটা বাধ্য হয়েই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাস চালাতে হয়। এক দিকে মালিকের
চাপ, অন্যদিকে নিজেদের আয়ের বিষয়টা। কেননা ট্রিপ অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয় তাদের। আর এ
কারণেই বেশি ট্রিপের আশায় বিশ্রাম না নিয়ে বাস চালান তারা। এ কারণে ক্লান্ত হয়ে যান।
তাই দীর্ঘ যানজট দেখে একটু বিশ্রাম নিয়েছেন তিনি।
আজিমপুর-আবদুল্লাহপুর
রুটে চলাচলকারী একটি বাসের চালক জানান, তাদের রুটটি একটু দীর্ঘ। আর এই যানজট অনেক বেশি।
দিনে দুই বার আসা যাওয়া করতে পারেন। অনেক সময় তাও হয়ে উঠে না। এ দিকে মালিকেরও চাপ থাকে।
তাই অনেকটা ভোরেই ট্রিপ নেওয়ার চেষ্টা করি। ফলে দুই-তিন বার ট্রিপ মারতে পারি। ট্রিপ
শেষে বাসায় যেতে পার হয় মধ্যরাত। ঘুমানোর জন্য সময় খুব অল্প পাই। বলা চলে ক্লান্ত
শরীর নিয়েই বাস চালাই।
এ সময় তিনি বলেন, ‘মালিকরা তো আমাদের ট্রিপ অনুযায়ী বেতন দেয়। তাই বাধ্য হয়েই বেশি ট্রিপ নেই।’
দূরপাল্লার
বাস চালক শহীদুল্লাহ জানান, সাধারণ সময়ে দিনে একবার যাওয়া-আসা করতে হয় তাদের। কিন্তু
দুই ঈদে যাত্রীদের চাপ অনেক বেড়ে যায়। সে সময় মালিকদের চাপে টানা ট্রিপ মারতে হয়। এমনকি
টানা কয়েকদিন নিদ্রাহীনও থাকতে হয় তাদের।
নিদ্রাহীন
এবং ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাস চালানো অনেকটা খাম-খেয়ালিপনার মতোই। বেশি ট্রিপের আশায় হোক
কিংবা অন্য কারণে হোক এতে নিরাপত্তা শঙ্কা থেকে যায় যাত্রীদের। অনেক সময় চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন
থাকার কারণে ভয়াবহ দুর্ঘটনার মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে আসে এ সব খামখেয়ালিপনার
দায় কে নেবে?
এ
বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরীর সঙ্গে।
তিনি এ খামখেয়ালিপনার দায় অনেকটাই দিয়েছেন বাস মালিকদের ওপরে। তিনি বলেন, ‘এ সব মূলত
বাস মালিকদের কারণেই হয়ে থাকে। কেননা মালিকদের উচিত বাসের চালকদের সচেতন করা এবং যাতে
চালক পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম নিতে পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া।’
তিনি
বলেন, ‘সরকারের কিছু নীতিমালা রয়েছে। মালিকরা সে নীতিমালা মানে না। আট ঘণ্টার বেশি নিরবচ্ছিন্ন
গাড়ি চালানো কোনো মতেই আইনসঙ্গত নয়। কিন্তু চালকরা অতিরিক্ত সময় বাস চালাচ্ছে। অনেক
সময় বাধ্য হয়ে, আবার অনেক সময় নিজের ইচ্ছাতে। যা সম্পূর্ণভাবেই আইনভঙ্গ করা। এ সব বিষয়ে
মালিকদের সচেতন হওয়া সবার আগে জরুরি। না হলে দায় মালিকদেরই নিতে হবে।’
পরিবহন চালানোর সময় চালকদের নিদ্রা থেকে দূরে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে পেনিক বাটন নামক একটি যন্ত্র রয়েছে যা চালকদের আসনে থাকা অবস্থায় ঘুমে বিঘ্ন ঘটায়। আমাদের মালিকরা চাইলে সে ব্যবস্থা নিতে পারে। এতে চালকরা পরিবহন চালানোর সময় ঘুম থেকে দূরে থাকতে পারবে।’
একই সঙ্গে পরিবহন চালোনোর সময় সড়কে চালকদের দায়িত্বশীল হওয়ার কথা বলেন তিনি।
তবে
এ সব খামখেয়ালিপনার দায় চালকদের বলেই জানিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘চালকদের জোর করেও গাড়ি থেকে নামানো যায় না। চালকরা
অনেকটা উগ্র মনোভাবে থাকেন। তাদের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে গাড়ি না চালাতে দিলে তারা
বাড়ি গিয়ে বসে থাকেন। ফলে গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এতে মালিক পক্ষ লসে পড়ে। তাই তাদের বিপক্ষে
ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’
তিনি
বলেন, ‘চালকদের স্বভাব অনকেটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে- যে তারা গাড়ি নিয়ে গেল, ব্যাক করলো, আবার যাবে-আবার আসবে। এভাবে চার-পাঁচদিন চালায় এরপর চার-পাঁচদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে
বসে থাকেন। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে বাধ্যকরণে কোনো ক্ষমতা নেই মালিকপক্ষের। আর বেশি সময়
চালানোর জন্য তাদেরকে বাধ্য করার কোনো সুযোগই নাই। কোনো মালিকই তার চালককে গাড়ি চালানোর
জন্য বাধ্য করতে পারেন না।’
চালকদের
ট্রিপ অনুযায়ী বেতন দেওয়া হয় বলে তারা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে বাধ্য হয়- এমন কথার জবাবে
এনায়েতউল্লাহ বলেন, ‘এটাই নিয়ম। তারা যত ট্রিপ চালাবে তত ট্রিপের টাকা পাবে। এখানে
তাদেরকে নির্দিষ্ট বেতনভুক্ত করার কোনো সুযোগ নেই। এটাই বাস্তবতা, আর এই বাস্তবতা নিয়েই
আমি দীর্ঘদিন পরিবহন ব্যবসা করে আসছি। অন্য মালিকদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম।’
এ সব খামখেয়ালিপনার কারণে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় নেবে কে, এমন প্রশ্নের জবাবে এনায়েতউল্লাহ বলেন, ‘দুর্ঘটনার দায় চালক কিংবা মালিক কোনো পক্ষই নেবে না। কেননা, দুর্ঘটনা অনাকাঙ্খিতভাবে হয়ে থাকে। চালকরা ইচ্ছেকৃতভাবে এক্সিডেন্ট করে না। বরঞ্চ তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাড়ি চালায়, কেননা তারা চেষ্টা করে যেভাবে বেশি ট্রিপ মেরে টাকা কামানো যায়। সুতারং অনাকাঙ্খিতভাবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কোনো পক্ষ নেবে না।’
এ
সংক্রান্ত খামখেয়ালিপনায় পরিবহন শ্রমিকদের দায় কতটা তা জানতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন
শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলিকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া
যায়নি।
তবে
এ সব খামখেয়ালিপনায় মালিক-শ্রমিকদের একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়াকে ইঁদুর-বেড়াল খেলা
বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের
পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে আমাদের দেশের আইনকে
বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এই সংস্কৃতির ফলে সড়কে নানা রকম বিশৃঙ্খলা
দেখতে পাই।’
তিনি
বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০০৬ এবং সড়ক পরিবহন আইন রয়েছে। যেখানে বলা আছে যে চালকদের কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। তাকে লিখিত নিয়োগপত্র দিতে হবে এবং বেতনভুক্ত করতে হবে। একজন
চালকের আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কখনও সম্ভব নয়। কিন্তু তা
মান্য করা হচ্ছে না। আমাদের পরিবহন মালিকরা এ সব আইন মেনে চলছেন না। এমনকি পরিবহন শ্রমিকদের
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছেন না। তাদের নিয়োগপত্র দেওয়া, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বেতনভুক্ত
করা। কিন্তু করছেন না। ফলে চালকরা বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছেন।’
ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না করার কারণে প্রায় সর্বনিম্ন ১৬ ঘণ্টা ড্রাইভ করেন একজন বাস চালক। বিশেষ করে রাজধানীতে এত যানজট উপেক্ষা করে টানা ১৬-১৮ ঘণ্টা বাস চালানো কোনো মানুষের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। কেননা আমাদের সড়কে বিশৃঙ্খলার মাত্রা এতটাই বেশি যে একজন চালকের গাড়ি চালানোর সময় ন্যূনতম মানসিক বিশ্রামের সময়টুকুও পাওয়া যায় না। তাকে সার্বক্ষণিক অতি মনোযোগের সহিত গাড়ি চালাতে হয়। তার হাত, পা চালাতে হয়। এমনকি মস্তিষ্কও সার্বক্ষণিক কাজ করতে থাকে। ফলে তার মস্তিষ্কের বিশ্রাম হয়ে উঠে না। এতে সে ক্লান্ত হয়ে যায়। আর ক্লান্ত শরীর নিয়েই সে গাড়ি চালায়, তখন দুর্ঘটনা ঘটে।’
এ সব বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সড়ক পরিবহন আইন ও শ্রম আইনের বিধিগুলো প্রয়োগ করতে হবে। না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এই আইন ভঙ্গ করার প্রশ্রয় দানে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মালিক পক্ষ উভয়কেই দায়ী করবো। কারণ রাজধানীতে যে বাসগুলো চলছে তাদের অনেকগুলোই ফিটনেসবিহীন। এমনকি চালকদেরও ন্যূনতম প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় নাই। এ সব কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোরতা অবলম্বন করেন না। তাই কিছুটা দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিতে হবে। তবে এর সবচেয়ে বড় দায় মালিক পক্ষের। কারণ তারা আইনের তোয়াক্কা করছেন না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে এ সব নিয়মের মধ্যে আনতে পারে। এই ধরেন, যদি শ্রমিকদের নিয়োগপত্র পরিবহনে থাকার বাধ্যবাধকতা থাকতো। এবং নিয়মত মনিটরিং করে আইনের প্রয়োগ করতো তাহলে সড়কে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা ফিরতো।’
মালিক
সমিতি দাবি করা শ্রমিকদের নিয়োগপত্র নিতে অস্বীকার করার বিষয়ে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘এটা মূলত
একটা অজুহাত। যাতে দায়িত্ব না নিতে হয়। কেননা যে শ্রমিক আপনার নিয়োগপত্র নেবে না
সেই শ্রমিকের হাতে মালিক কোনো যুক্তিতে স্টিয়ারিং দিতে পারেন না। যখন স্টিয়ারিং দেয়
তখন বুঝতে হবে মালিক পক্ষ আইনভঙ্গ করছেন।’
ক্লান্ত
শরীর নিয়ে চালকদের গাড়ি চালানোর বিষয়ে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আসলে চালকরা মালিকদের নিকট দায়বদ্ধ না। তাই মালিকরা
তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে মালিকদের উচিত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ সৃষ্টি
করা। না হলে তাহলে চালকদের বেপরোয়াভাবে থামবে না। আর মালিকরাও গাড়ি চলাচলে শ্রমিকের
ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।’
আর
দুর্ঘটনা রোধে এবং ক্লান্ত শরীর নিয়ে যেন চালকরা বাস না চালাতে পারে সে জন্য আধুনিক
প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শ্রম আইন ও সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানান তিনি।
এআরআই/এএল