• ঢাকা রবিবার
    ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ১১ ফাল্গুন ১৪৩১

১৫ আগস্ট : ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়

প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০২২, ০৬:১৬ এএম

১৫ আগস্ট : ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়

শৈবাল আদিত্য

আজ ১৫ আগস্ট৷ জাতীয় শোক দিবস৷ আগস্ট মাস বেদনার মাস। আগস্ট এলেই ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুর স্মৃতির পীড়ন তাড়িত করতে থাকে আমাদের। আমরা বিপন্নবোধ করি, অসহায় বোধ করি। জাতির পিতার অকাল মৃত্যুর দগদগে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে থাকে গোটা জাতি।

লেখার শুরুতে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেই সঙ্গে স্মরণ করছি ১৫ আগস্টে যারা শাহাদাত বরণ করেছেন তাঁদের সবাইকে। তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বিশ্বের ইতিহাসে এক কালো এবং বর্বরতম ঘটনা। কারণ ঐদিন খুব সকালে নৃশংসভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে সিঁড়ির নিচে অবস্থানকারী ঘাতকের হাতের স্টেনগান। আঠারোটি গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় বঙ্গবন্ধুর বুক। জাতির পিতা পড়ে যান সিঁড়ির ওপর। তার বুকের রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে সেই রক্তের স্রোত। যেই রক্তে মিশে আছে আমাদের জাতির স্বপ্ন, আকাংখা, বাসনা। ষড়যন্ত্রের বুলেটে বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের সবাইকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই ষড়যন্ত্র আমরা সবাই বুঝতে পারি। যে দেশকে স্বাধীন করল তাঁকে এইভাবে হত্যা করতে পারে মানুষ। ভাবতে কষ্ট লাগে, কি নির্মম, কি নিষ্ঠুর! কি এক হতাভাগা জাতি আমরা! এই হত্যাকান্ডের ফলে আমরা শুধু বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই পরিচিতি পাইনি বরং বিশ্বের সামনে আমরা এক অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হয়েছি সেই খুনিদের জন্য। 



১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর নোবেলজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালী শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে। 

ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালীদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, 'বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা জাতি হিসেবে বিশ্বের মানুষের কাছে আত্মঘাতী চরিত্রই প্রকাশ করেছে।' ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দ্য টাইমস অব লন্ডন এ প্রকাশিত জার্নালে বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবন বিশ্ব স্মরণ করবে। কারণ তাঁকে ব্যতীত বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই।' 

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুর ন্যক্কারজনক হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে মনে করছে এবং করবে বাংলাদেশের জনসাধারণ। যদি ১৫ আগস্টের মীর জাফরদের ঘৃণিত কর্মকান্ড সম্পর্কে কারও একটুও ধারণা থাকে, তবে কারও পক্ষেই ঐ ঘাতকদের মানুষ বলে মনে করা সম্ভব না। এরা কাপুরুষ এবং জাতির সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই। এদেরকে নিয়ে কথা বলার মতো রুচিও মানুষের নেই। এরা কি যে নিন্দনীয় এবং পাষন্ডের মতো কাজ করছে! তাদেরকে ঘৃণা জানানোর ভাষাও জানা নেই। জাতি তাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না।' 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়, কিন্তু বিচারের কার্যক্রম শুরু হয় অনেক বছর পরে। এটাও জাতির জন্য আরেক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা হয় এবং হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে এই হত্যাকান্ডের বিচারের গতিশীলতা ফিরে পায় বাঙালী জাতি ও দেশের নাগরিক। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে মৃত্যদণ্ড দিয়ে রায় দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত। কিন্তু ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে তিন জনকে খালাস দিয়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া ১২ খুনীর মৃত্যদণ্ড আপীল বিভাগেও বহাল রেখে আদেশ জারি করা হয়। অনেকের ফাঁসি কার্যকর হলেও যাদের ফাঁসির রায় এখনও কার্যকর হয়নি তাদেরকে দেশে এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে পারলেই দেশের জনগণ শান্তি পাবে এবং কলঙ্ক থেকে মুক্তি পাবে। 

নতুন প্রজন্মের একজন নাগরিক হিসেবে আজও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কিভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল কিছু দুষ্কৃতকারী। ভাবতে আমি শিউরে উঠি আতঙ্কে। কারণ যে মানুষটি জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তাঁর মোট জীবনের এক-চতুর্থাংশ, যাকে ২০ বার গ্রেফতার করা হয় শুধু দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে, যার অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর সাহস দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা এনে দেয়, তাকেই নিহত হতে হয় দেশের কিছু পথভ্রষ্ট কুলাঙ্গার মানুষের হাতে। আজকে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি, স্বাধীন একটি মানচিত্র পেয়েছে শুধু তাঁর নেতৃত্বের কারণে। যে নেতার কারণে আজ বাঙালী জাতি বিশ্বের দরবারে পরিচিত। আমরা এক হতাভাগা জাতি যে তার মতো নেতাকে মেরে ফেলছি। 

আজ আমরা বিশ্বের ৩৮তম শক্তিশালী অর্থনীতিক দেশ, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন আজ আমরা আরও উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে থাকতে পারতাম। তাঁর নেতৃত্বে যে গুণ, দক্ষতা এবং দুরদৃষ্টি ছিল, তা আর কারও মধ্যে নেই। তাঁর হত্যার ঘটনা যখন পড়ি, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। 

শোকাবহ আগস্ট মাস যখন আসে তখন চিন্তা করি শেখ রাসেলের কথা। সেই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে পাষণ্ড ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি ছোট শিশু রাসেল, এমনকি পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা বধূও। রাসেলের মতো নিষ্পাপ ছেলেটিকে বন্দুকের গুলিতে হত্যা করল খুনীরা, মৃত্যুর আগে তার অনুরোধটুকুও কি ঘাতকের মনে একটু দয়া সঞ্চার করতে পারেনি! চিন্তা করলে শরীর কেঁপে ওঠে, থমকে যায় স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা এবং সবকিছু স্তম্ভিত হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। 

প্রতি বছরের মতো এবারও আগস্টে মাসব্যাপী কর্মসূচী শুরু হয়েছে ১ আগস্ট থেকে। আগস্টের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্বলন, আলোর মিছিল ও জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কর্মসূচীর সূচনা হয়েছে। বাঙালী জাতির জন্য অত্যন্ত শোকাবহ এবং বেদনাদায়ক একটি মাস আগস্ট। এই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরমতম ঘৃণিত ও কলঙ্কিত এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল। আগস্টে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল বাঙালীর স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঐ দিন আমাদের জাতির পিতা, মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল শ্যামল বাংলার মাটি। সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যা ঘটেছিল তা পৃথিবীর কোন সুষ্ঠু মানুষ মেনে নিবে না। বরং ঐ ঘাতকদের ঘৃণা করবে এবং বলবে যে বিশ্বের ইতিহাসে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার যেন আর কোন পুনরাবৃত্তি না হয়। 

এই আগস্টেই ঘটেছিল জাতির ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে চালানো গ্রেনেড হামলা থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী ঐদিন শাহাদাত বরণ করেছিলেন। আগস্ট আসলে ভয় লাগে কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলমান। তাই সরকারের সব কর্মকর্তা এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। ১৫ এবং ২১ আগস্ট এক সূত্রেই গাঁথা, কারণ ষড়যন্ত্রকারী ছিল একই আদর্শের। উদ্দেশ্য এক ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ধ্বংস করা। যদিও তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং আমরা জাতির পিতাসহ দেশের অনেক গুণী মানুষ আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়েছি। তাই আমি মনে করি ষড়যন্ত্র এখনও থেমে থাকেনি। সুতরাং আমাদের সর্বক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে দেশ কোনভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে না চলে যায়। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ আর নড়বড়ে অর্থনীতি সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক কার্যকরী এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যা ঐ সঙ্কট পরিস্থিতি ভালভাবেই সামলে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের গভীর কূটকৌশলের ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের উপস্থিত সব সদস্যসহ অত্যন্ত নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। ফলে সাময়িকভাবে কিছুটা থমকে যায় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখা। তবে ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। কেবল ১৫ আগস্ট নয়, শোকাবহ আগস্টের প্রতিটি দিন; মাসজুড়ে বাঙালী জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মানুষ ধিক্কার জানাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকারী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের, খন্দকার মোশতাকদের।

দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া ও নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের চূড়ান্ত রায় এবং পাঁচ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা হয়েছে। আমি মনে করি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাকি খুনীদের দেশে এনে বিচার নিশ্চিত করতে অব্যাহত তৎপরতা জারি রাখবেন। আগস্টের শোকের এই দুঃখজনক ইতিহাসের দায়মোচনের তরে এটাই আজকের বাংলাদেশের কাছে আমাদের প্রত্যাশা।

এসএ/

জাতীয় সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ