আবু রায়হান ইফাত
মন্তব্য কখনো গন্তব্য ঠেকাতে পারে না- এমনই অভিব্যক্তি দিয়েছিল নাটোরের সেই শিক্ষিকা-ছাত্র দম্পতি। কিন্তু দিন শেষে মন্তব্যই কি কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জীবনে, প্রশ্ন ওঠে এমনই। রোববার (১৪ আগস্ট) ভাড়া বাসা থেকে ওই শিক্ষিকা খায়রুন নাহারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এমনকি আটক করা হয় স্বামী মামুনকে। মামুনের দাবি, আত্মহত্যা করেছেন তার স্ত্রী। যদিও এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে বিষয়টি।
উল্লেখ্য, গত বছর ডিসেম্বরে গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর এমহক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোছা. খায়রুন নাহার (৪০) ভালোবেসে বিয়ে করেন কলেজ ছাত্র মামুনকে (২২)। মামুন নাটোর এনএস সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বিয়ের পর ৬ মাস আড়ালে ছিলেন তারা। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশ পায় তাদের বিয়ের বিষয়টি। সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয় বিষয়টি। তাদের এই অসম মিলনকে কেউ জানিয়েছেন সাধুবাদ। আবার কেউ কেউ তা নিয়ে করেছেন ট্রল, যার সংখ্যাটাই বেশি।
খায়রুন নাহার ও মামুন দম্পতি সে সময়টা অনেকটা দৃঢ় মনোবলেরই ছিলেন বলা যায়। তারা বলেছেন, ‘কোনো প্রকার নেতিবাচক মন্তব্য তাদের ভালোবাসা থেকে দূরে রাখতে পারবে না।’ এমনকি এটাও বলেছেন তারা, মন্তব্য কখনো গন্তব্য ঠেকাতে পারে না। তবে কি সেই মন্তব্যের কারণেই প্রাণ দিতে হলো খায়রুন নাহারের?
ধরে নেয়া যাক, আত্মহত্যা করেছেন খায়রুন নাহার। কিন্তু তার এই হত্যার দায় নেবে কে? প্রতিনিয়ত মানুষের ট্রল এবং বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতেন তারা। যে মন্তব্যগুলোকে নীরব আঘাতই বলা চলে। আঘাতে জর্জরিত হয়ে এক সময় মৃত্যুর পথটাই বেঁচে নিলেন তিনি। গলায় ফাঁস দিয়ে করলেন আত্মহত্যা।
খায়রুন নাহারের মরদেহ উদ্ধারের পর বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যেখানে অনেকেই তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে সামাজিক রোষাণলকে দায়ী করেছেন। তাদেরই একজন এখন টিভির সাংবাদিক মোহাম্মদ তৌহিদ হাসান। তিনি বলেন, 'শিক্ষক-ছাত্রের অসম প্রেমের গন্তব্য ঠেকে গেল। অবশ্যই এই মৃত্যুর দায় গণমাধ্যম, গণমাধ্যমকর্মীদের এবং আমাদের.. যারা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছি।'
মাহমুদুল হাসান নামক একজন বলেন, 'আমাদের মানসিকতা ক্রমশই নিচু হচ্ছে। মানুষে নিচু মানসিকতার কারণেই প্রাণ দিতে হয়েছে ওই শিক্ষাকে।’
তিনি বলেন, 'আমাদের সমাজে অসম সম্পর্ক তখন মেনে নেয় যখন পুরুষের বয়স হবে ৪০ আর মেয়ের বয়স আঠারো। তখন বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেয়। কিন্তু শিক্ষিকা-ছাত্র দম্পতির বিষয়টি মানুষ সেভাবে গ্রহণ করতে পারেননি তাই তারা বিষয়টিকে ট্রলে পরিণত করেছেন। আর এতেই আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিয়েছেন ওই শিক্ষিকা।'
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামাল হোসেন এর সাথে। তিনি বলেন, 'বিষয়টি যদি আত্মহত্যা হয়ে থাকে তাহলে এর সম্পূর্ণ দায় সমাজের। কেননা সমাজ বিষয়টির মাঝে বিষ মিশ্রিত করেছে। আর এতে ওই নারী আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'ভারতে এক অভিনেত্রী তার চেয়ে কম বয়সী ছেলেকে বিয়ে করেছিল, সেটা সবাই মেনে নিয়েছে। এমনকি আমাদের দেশে কমবয়সী মেয়ের সাথে বেশি বয়সী পুরুষের বিয়ে হয় সমাজ সেটা মেনে নেয়। কিন্তু ওই দম্পতির বিষয়টি সমাজ মেনে না নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করেছে। আর এই ট্রলের শিকার হওয়ার কারণে যদি আত্মহত্যার মতো ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে এর জন্য পরোক্ষভাবেই সমাজ দায়ী।'
অধ্যাপক কামাল বলেন, 'যারা আত্মহত্যা করে তাদের ব্যক্তি কাঠামো অনেকটা দুর্বল। এই ধরুন, ওই নারী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। তার উচিত ছিল, সমাজ যাই বলুক সেগুলো গায়ে না মাখা। তার প্রমাণ করা দরকার ছিল যে আমরা যা করেছি তা ঠিক করেছি। বয়সের পার্থক্য ভালোবাসার মাঝে বাধা হতে পারে না।'
তিনি বলেন, 'ওই দম্পতি বিয়ে করার আগে নিশ্চয়ই ভেবেছিল সমাজ কিভাবে নিবে বিষয়টা। কিংবা আমাদের সমাজে এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাছাড়া, আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পোষণ করে। এদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই হয়েছিল। সম্ভবত তারা প্রথমে সহ্য করে নিচ্ছিল, কিন্তু ট্রলের পরিমান মাত্রারিক্ত হওয়ার কারণে একসময়ে মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই আত্মহত্যা করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সামাজে ন্যায়-অন্যায় কিংবা সামাজিক চাপে অনেক কিছুই ঘটে থাকে। কিন্তু একটা বিষয় তা হলো- সমাজে ইতিবাচক কোনো কিছু নিয়ে জনমত গঠন করাটা যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই সহজ নেতিবাচক কিছু নিয়ে জনমত গঠন করা। ওই শিক্ষিকার মৃত্যুর কারণ যদি ট্রল হয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো, যারা এর জন্য দায়ী তাদের আইনের আওতায় আনা।'
কথা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দীন কাউসার বিপ্লবের সাথে। তিনি বলেন, 'আমাদের সমাজে মানুষের মাঝে কোনো কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়ার স্বভাবটা হারিয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে থাকেন তারা। এ ফল ভোগ করতে হয় অন্যদের।'
তিনি বলেন, ‘খায়রুন নাহার নামক এই শিক্ষিকার মৃত্যু যদি আত্মহত্যা হয়ে থাকে। তাহলে এর দায় সমাজকেই নিতে হবে। কিন্তু সমাজ কি এর দায় নেবে? দেখা যাবে এ ঘটনা দু-একদিনে হারিয়ে যাবে। আবার নতুন কোনো ঘটনা জন্ম নিবে। মানুষ সেটাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করবে, ট্রল করবে। আর তখনও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এসব মুলত আমাদের নৈতিক ও পারিবারিক শিক্ষার অভাবেই হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সমাজের উচিত হবে, প্রতিটা মানুষই যেনো সঠিকভাবে পারিবারিক শিক্ষাটা পায়। এ ছাড়া ভবিষৎে যেনো ভাইরাল ও ট্রলের মতো ঘটনার শিকার হয়ে কাউকে প্রাণ না হারাতে হয় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া।'
ডা/
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন