প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২২, ০৩:০৫ পিএম
দেশের
বিভিন্ন অঞ্চলে বয়ে চলেছে তাপদাহ। এতে ভোগান্তি নেমে এসেছে জনজীবনে। প্রখর রোদের
কারণে তৈরি হওয়া ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তিতে পড়েছে মানুষ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, তাপপ্রবাহের এমন
পরিস্থিতি চলতে পারে আরও দু’দিন।
ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ
জায়গায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় এই তাপমাত্রা অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া
অধিদফতর। ঢাকা, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী ও
চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ রংপুর,
রাজশাহী ও সিলেট
বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত
থাকতে পারে।
আবহাওয়াবিদ ড. মোহাম্মদ
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, মূলত পাঁচটি
কারণে এখন এ উষ্ণ পরিস্থিতি। এগুলো হলো-বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা অতিরিক্ত জলীয়
বাষ্প, কয়েকদিনের
বৃষ্টিশূন্যতা, আকাশের আংশিক
মেঘলা অবস্থা, সারা দেশে
স্বাভাবিকের ১-৬ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা এবং বাতাসের মৃদু গতিবেগ। তিনি বলেন, উড়িষ্যা ও
তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে লঘুচাপে পরিণত হয়ে একই
এলাকায় অবস্থান করছে।
এর বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব
বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প
আসছে। এ অতিরিক্ত জলীয় বাষ্পই বাড়তি গরমের অনুভব তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, মানুষের শরীর
একটি তাপ ইঞ্জিন। শরীরের ভেতর থেকে লোমকূপের মাধ্যমে ঘামের সাহায্যে তাপ বিকিরণ
করে। কিন্তু বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকলে ঘাম শরীরে লেপ্টে যায়। এতে বাড়তি গরম
অনুভূত হয়।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে
প্রায় সারা দেশে বৃষ্টি কম হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার আগের ২৪ ঘণ্টার রেকর্ডে
দেখা গেছে, আবহাওয়া অধিদফতর
(বিএমডি) যে ৪২ স্টেশনে আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এরমধ্যে ছয়টিতে বৃষ্টির
তথ্য পাওয়া গেছে। সর্বোচ্চ বৃষ্টি মাত্র ১৫ মিলিমিটার শ্রীমঙ্গলে হয়েছে। এ
বৃষ্টিহীনতা ধরণীকে উষ্ণ করে তুলছে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, তাপমাত্রার
সর্বোচ্চ অবস্থাটি সাধারণত বিকিরণের মাধ্যমে হ্রাস পায় রাতে। কিন্তু গত কয়েকদিন
ধরে সেটি হচ্ছে না। সারা দেশেই দিনের ও রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকছে। এছাড়া
সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির কম। বৃহস্পতিবার সকালের
বুলেটিন অনুযায়ী-সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সেখানে সর্বনিম্ন
তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি
সেলসিয়াস, আর সর্বনিম্ন ছিল
২৯ ডিগ্রি। সাধারণত ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬
থেকে ৩৮ ডিগ্রির নিচে তাপমাত্রা থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। ৪০ ডিগ্রির
বেশি হলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে।
বর্তমান তপ্ত পরিস্থিতির
জন্য আকাশের মেঘলা অবস্থাকেও দায়ী করা হচ্ছে। জুন-জুলাইয়ে দিনের ব্যাপ্তিকাল
দীর্ঘ। সূর্যের তাপ সাধারণত বিকিরণ হয়ে আকাশের দিকে চলে যায়। কিন্তু আকাশ আংশিক
মেঘলা থাকায় তা আবার ভূপৃষ্ঠের দিকে ফিরে যায়।
নরওয়েভিত্তিক আবহাওয়া
সংক্রান্ত ওয়েবসাইট টাইম অ্যান্ড ডেট জানায়, বৃহস্পতিবার বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকায়
তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তখন বাইরে এর অনুভূতি ছিল ৫১ ডিগ্রি
সেলসিয়াসের মতো।
বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই)
সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ওড়িশা ও তৎসংলগ্ন
এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি দুর্বল হয়ে লঘুচাপে পরিণত ও উত্তর ওড়িশা
তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত
বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, মধ্য প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল, গাঙ্গেয়
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু
বাংলাদেশের ওপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি ধরনের
সক্রিয় রয়েছে।
বিএমডির সহকারী
আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা জানান, ঢাকা, রংপুর, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলা এবং রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের ওপর
দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায়
বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে পারে।
সিলেটে টানা তাপদাহে
দুর্বিষহ জনজীবন : সিলেট ব্যুরো জানায়, ঈদের দিন থেকে প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ছে সিলেট।
দিনভর সূর্যের আগুন যেন মাটিতে গলে পড়ছে। রাতেও নেই স্বস্তি। আষাঢ়ের শেষ দিকে এমন
আগুনঝরা রোদ দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন।
প্রতি বছর এ মৌসুমে
সিলেটের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও প্রকৃতির এমন প্রতিকূল
আচরণে এবার বদলে গেছে দৃশ্যপট। পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। বৃষ্টি
নেই, বাতাস নেই, সঙ্গে লোডশেডিং।
সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন সিলেটের মানুষজন।
আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা
গেছে, ঈদের দিন সিলেটে
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর থেকে সিলেটে ক্রমশ
তাপমাত্রা বাড়ছে। সোমবার ছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মঙ্গলবার তাপমাত্রা ছিল
৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরের দিন বুধবারের তাপমাত্রাও ছিল ৩৭ দশমিক ৩ ডিগ্রি
সেলসিয়াস। বৃহস্পতিবার তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। আজ তাপমাত্রা আরও
বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের
জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ জানান, ঈদের আগে থেকে সিলেটে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
এবার ঈদ কেটেছে বৃষ্টিহীন। বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও বৃষ্টি নেই। তাই তাপপ্রবাহ
দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিয়েছে। মার্চ-এপ্রিলের তীব্র তাপপ্রবাহের পর থেকে সিলেটের ওপর
দিয়ে কখনো মৃদু আবার কখনো মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে। ভারি বর্ষণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত
এ তাপপ্রবাহ প্রশমিত হওয়ার আপাত কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে সপ্তাহের শেষে বৃষ্টিপাতের
সম্ভাবনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, শনিবার থেকে তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনা আছে, সেদিন নগরীসহ
সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিপাত হতে পারে।
স্মরণকালের প্রচণ্ড
দাবদাহে রংপুরের জনজীবন : রংপুর ব্যুরো জানায়, ভরা বর্ষা মৌসুমের মধ্যভাগে এসেও রংপুরে
চৈত্র-বৈশাখের মতো দাবদাহ ও গরম পড়ছে। স্মরণকালের প্রচণ্ড গরম আর তাপদাহে জনজীবন
বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দাবদাহ ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে।
এর আগে বুধবার তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল। যা সাম্প্রতিক সময়ে
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
দাবদাহে রংপুর নগরীসহ
উত্তরের আট জেলায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সড়ক ও দোকানপাটে মানুষের উপস্থিতি
কমে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ঘরে ঘরে জ্বর, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, হিট স্ট্রোকসহ
নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষজন। তিন দিনে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ৩০ জন
হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ
দিয়েছেন চিকিৎসকরা। প্রচণ্ড গরমে কৃষক, রিকশাচালক ও শ্রমজীবীরা চরম বিপাকে পড়েছেন।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের
সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, এক সপ্তাহ ধরে রংপুর অঞ্চলে অস্বাভাবিক আবহাওয়া
বিরাজ করছে। এ তাপমাত্রা আরও ২ থেকে ৩ দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
জেডআই/