প্রকাশিত: জুলাই ১৪, ২০২২, ০৩:৪১ এএম
বিভিন্ন মাধ্যমে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে ই কমার্স প্রতিষ্ঠান
আলেশা মার্ট। ঢাক ঢোল পিটিয়ে বাজারে আসলেও কাস্টমারদের নানা ধরনের ভোগান্তিতে
ফেলছে তারা। গ্রাহকদের নানা প্রলোভনে ফেলে মেম্বারশিপ বিক্রি করছে। কিন্তু মেম্বারশিপ
এর যথাযথ কোন সুবিধা পাচ্ছে না গ্রাহকরা। অর্ডারের নামে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের
সঙ্গে নানা কৌশলে প্রতারণা শুরু করেছে।
তারা বিভিন্ন প্রকার
আন-অফিসিয়াল মোবাইল ফোন সেট বিক্রয় করছে যা থেকে বাংলাদেশ সরকার অনেক রাজস্ব
হারাচ্ছে। আবার লোভনীয় অফার দিচ্ছে বাইকের উপর। বলা হচ্ছে ১-৩৫ দিনে ডেলিভারি
সম্পূর্ণ করবে। কিন্ত একজন কাস্টমার বাইক অডার করলেই তাদের কাছে জিম্মি হয়ে
যাচ্ছে।
আগে আসলে আগে পাবেন ফর্মূলা অনুযায়ী ডেলিভারি প্রসেসিং করার কথা থাকলেও তাদের রিলেটিভ ২-৪ জনকে দিয়ে প্রতিদিন ডেলিভারি সম্পূর্ণ করছে। প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে তাদের পেজে ঢালাও ভাবে নিউজ প্রচার করছে। যাতে কাস্টমার আকৃষ্ট হয়। বাস্তবে তারা ১০০০ অডার পেলেও ডেলিভারি করছে ৫-১০ টি বাইক আর মোটা অংকের ফান্ড কালেকশন করছে।
চটকদার বিজ্ঞাপন, বিশাল ছাড়ের
প্রলোভন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়ে পণ্য না দেওয়ার বিষয়টি অধিকাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান
করেছে। তবে আলেশা মার্ট ক্রেতার সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে সেটি অন্যগুলোর চেয়ে
আলাদা। আলেশা মার্ট অভিনব কায়দায় ক্রেতার তথ্য সংগ্রহ করে মোটা অঙ্কের টাকায়
বিক্রি করে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ
অধিদফতর আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালায়। অভিযানের সময় আলেশা মার্টের
ব্যবসার ধরন, পণ্য বিক্রি, চটকদার বিজ্ঞাপন
এবং ক্রেতা ঠকানোর নানা বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হয়। আলেশা মার্টের প্রধান কার্যালয়ের
তথ্য যাচাইয়ের সময় ভোক্তা অধিদফতর জানতে পারে, আলেশা মার্ট গোপনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে
ক্রেতার তথ্য মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। বিষয়টি ক্রেতাদের অবগত করা
হয়েছে কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, ক্রেতারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। আলেশা মার্ট
কার্ডের মাধ্যমেও রমরমা বাণিজ্য করছে। কার্ডের মাধ্যমে সেবা দেওয়ার জন্য ৩ হাজার
৮০০ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে আলেশা মার্ট। এই কার্ডের মাধ্যমে ডিসকাউন্টে
পণ্য বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে কাপড়ের দোকান, খাবারের হোটেল, আবাসিক হোটেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন ধরনের
প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আলেশা কার্ড ৭ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আলেশা মার্ট মূলত
এই কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা কোন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পণ্য কিনতে বেশি
যাচ্ছেন, কী ধরনের পণ্য
বেশি কিনছেন, কোন ক্রেতা
কেনাকাটায় বেশি অর্থ ব্যয় করছেন- এসব তথ্য সংগ্রহ করছে। এসব তথ্য সংগ্রহ করে
প্রতিষ্ঠানটি ক্রেতার একটি ডাটা ব্যাংক তৈরি করছে। এই ডাটা ব্যাংক তৈরির জন্য
ইতোমধ্যে ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগও করেছে আলেশা মার্ট। পরে গ্রাহকের এই ডাটা বা তথ্য
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে আলেশা মার্ট মোটা অঙ্কের অর্থের
বিনিময়ে।
ভোক্তা অধিদফতরের
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান
কাস্টমার সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়- গ্রাহকরা কোন পণ্য বেশি কিনছে, কোন কাস্টমার
বেশি অর্থ ব্যয় করছে। পরে সেসব গ্রাহকের সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করে
তাদের পণ্য বিক্রির জন্য। কিন্তু আলিশা মার্ট এটা করত সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে। কারণ
কাস্টমারের এসব তথ্য যে সংগ্রহ করা হতো সেটি গ্রাহককে জানানো হতো না। অর্থাৎ
গ্রাহকের অজান্তে গ্রাহকের তথ্য অন্যত্র বিক্রি করত আলেশা মার্ট। এটা তাদের
ভিন্নধর্মী একটি ব্যবসা। আলেশা সলিউশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মাধ্যমেই এ
কাজ করে আসছিল আলেশা মার্ট।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদফতরের
এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের যেকোনো তথ্য গোপনে
অন্যত্র বিক্রি করতে পারে না। আলেশা মার্ট যে কাজটি করে আসছিল সেটি অনৈতিক। আমরা এ
বিষয়ে তাদের সতর্ক করেছি।
ব্যবসা শুরু করে মাত্র
তিন মাসে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে ৪ কোটি টাকা। এনবিআরের একটি টিম তদন্ত করে
রাজস্ব ফাঁকির এসব তথ্য উদ্ঘাটন করেছিলো।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
(এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে,
চলতি বছরের
জানুয়ারিতে ব্যবসা শুরু করে আলিশা মার্ট। প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব ফাঁকি দিতে পারে
আশঙ্কা করেন ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট কমিশনারেট
উত্তরের একটি দল আলিশা মার্টের প্রিন্ট করা বিক্রয় তথ্য, বাণিজ্যিক
দলিলাদিসহ ৯২ পাতার সফট কপি জব্দ করে। মূলত সঠিক রাজস্ব নির্ণয়ের জন্য ঢাকা উত্তর
ভ্যাট কমিশনার এসব জব্দ করে। পরবর্তীতে এসব দলিলাদি পরীক্ষা করে ভ্যাট ফাঁকির
প্রমাণ পাওয়া যায়। জব্দ তালিকা যাচাইবাছাই করে দেখা গেছে, আলিশা মার্ট ২
কোটি ১৭ লাখ ১৭ হাজার টাকার বিক্রয় তথ্য গোপন করেছে। যার ভ্যাটের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০
লাখ ৮৫ হাজার ৮৬২ টাকা। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন, মার্কেটিং ব্যয়, পারচেজ ক্যাম্পেইন, কস্ট অব গুডসের
তথ্যও গোপন করে আলিশা মার্ট। এভাবে ৪ কোটি ২২ লাখ ৬১ হাজার টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়
প্রতিষ্ঠানটি। তিন মাসের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা
রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে আলিশা মার্ট।
আলেশা মার্ট গ্রাহকের
সঙ্গে ভয়াবহ প্রতারণা করেছে। ৮ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার নিয়ে ডেলিভারি না
দিয়ে মাসের পর মাস ঘোরাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এর বাইরে বিভিন্ন প্রকারের আরও ৫ হাজার
পণ্যের অর্ডারের অধিকাংশই আটকে রাখা হয়েছে। অথচ এসব পণ্যের অর্ডার দেওয়া গ্রাহকরা
অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে রেখেছেন আলেশা মার্টকে। শুধু মোটরসাইকেলের অর্ডার দেওয়া
গ্রাহকের ১৪৬ কোটি টাকা আটকে রেখেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটি।
আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান
মঞ্জুরুল আলম শিকদার সর্বশেষ ২৫ জুন ফেসবুক লাইভে এসে বলেছিলেন ৫ জুলাই থেকে
সবাইকে পেমেন্ট দেওয়া হবে। এদিকে গত ১৮ মে আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম
শিকদারের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন আবু সাঈদ নামের এক গ্রাহক।
আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে ২৮ জুনের মধ্যে তাকে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারি করেন।
কিন্ত ঐদিন আসামি মঞ্জুরুল আলমের আদালতে
হাজির হওয়ার দিন ধার্য থাকলেও তিনি আদালতে হাজির না হওয়ায় ৩০ জুন চেক
প্রতারণার মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। গ্রেফতার সংক্রান্ত তামিল
প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন আদালত।
আগাম অর্থ নিয়ে সময়মতো
পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় ই-কমার্স কোম্পানি আলেশা মার্টের কাছে গ্রাহকের
পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩০০ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী প্রতিষ্ঠানটির অর্থের উৎস এবং গ্রাহকের অর্থ তারা কোথায় রেখেছে তা খুঁজছে।
প্রতিষ্ঠানটির একাধিক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট আছে। সেই অ্যাকাউন্টগুলোতে কতো টাকা
রয়েছে এবং কতো টাকা লেনদেন হয়েছে তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে আলেশা মার্টের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর আলম শিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তার কাছে বক্তব্য চাওয়া হলেও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি। বক্তব্য নেয়ার জন্য কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তাদের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের প্রশ্ন কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না আলেশা মার্টের চেয়ারম্যানকে?
জেডআই/