সিটি নিউজ ডেস্ক
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কোনো সুখবর দেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৃহস্পতিবার (৯ জুন) জাতীয় সংসদে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে চতুর্থবারের মতো যে বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, সেখানে তাদের জন্য নতুন পে-স্কেল বা নবম বেতন কাঠামো ঘোষণা হয়নি।
যদিও বেতন-ভাতা বাড়াতে প্রস্তাবিত বাজেট থেকে নতুন পে-কমিশন গঠন এবং কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নবম বেতন স্কেল বাস্তবায়ন দাবি করেছিলেন সরকারি চাকরিজীবীরা।
একই সঙ্গে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা না হওয়ার আগ পর্যন্ত মাঝের পুরো সময় চলতি বেতন স্কেলের সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা প্রদানসহ আট দফা বাস্তবায়নের দাবিতে বর্তমানে তারা আন্দোলনেও রয়েছেন।
তবে প্রস্তাবিত বাজেটে এ সম্পর্কিত কোনো পদক্ষেপ না দেখে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকা নেতারা।
তারা বলছেন, এ বাজেট তাদের হতাশ করেছে। তবে দাবির সপক্ষ থেকে তারা সরে আসবেন না। বাজেটে ঘোষণা থাকলে ভালো হতো, কিন্তু বাজেটে নতুন পে-কমিশন গঠনের পদক্ষেপ না থাকলেও আগের (৮ম) পে কমিশনকে স্থায়ী ঘোষণা করতে পারে সরকার। এর জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি যথেষ্ট।
এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সরকারি কর্মচারী দাবি আদায়ে ঐক্য ফোরামের সমন্বয়ক ও সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভুইয়া মিলন বলেন, ‘আমরা পুরোপুরি হতাশ। আমাদের যৌক্তিক ও মানবিক দাবি নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। সরকারও স্বীকার করেছেন যে নতুন একটি পে-স্কেল দেয়ার সময় হয়েছে। আশা করেছিলাম বাজেটে নতুন বেতন কমিশন গঠন নিয়ে একটি ঘোষণা আসবে। তা না হওয়ায় আমরা যারপরনাই হতাশ হয়েছি।’
তিনি জানান, ২০১৫ সালে সর্বশেষ জাতীয় বেতনস্কেল প্রদানের পর গত ৭ বছরে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, চিকিৎসা ব্যয়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য প্রতিনিয়ত অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে সীমিত আয়ের সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য নতুন জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণা ও বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক।
তিনি বলেন, ‘পে স্কেল ঘোষণাসহ সাত দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আমরা সরকারি চাকরিজীবীরা এখন আন্দোলনে আছি। আমরা শিগগিরই বসব, এরপর নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব।’
দেশে বর্তমানে প্রজাতন্ত্রের প্রায় ২২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের রাজকোষ থেকে বেতন-ভাতা নেন। এ তালিকায় রয়েছেন শতভাগ সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছাড়াও সারা দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা।
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার পেছনে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ২ শতাংশ। এর বাইরে পেনশন বাবদ খরচ হওয়ার কথা অতিরিক্ত ২৩ হাজার কোটি টাকা।
এ বিরাট অর্থ খরচের সংস্থান প্রতিবছর ঘোষিত জাতীয় বাজেটের মাধ্যমে রাখা হয়। তার ধারাবাহিকতায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেতন-ভাতাবাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭৬ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার দাবি যৌক্তিক। কিন্তু এই বাজেটটি নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার উপযুক্ত সময় নয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যখন এই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে, তখন সমগ্র বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থির পরিস্থিতিতে এখন সময় যেকোনোভাবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে পণ্যমূল্য ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা।
এর জন্য বাজেটে প্রণোদনা, ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তাজনিত ব্যয়ের অঙ্ক আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ব্যাপকভাবে বাড়াতে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন পে স্কেল দাবি যৌক্তিক হলেও এখন এ খাতে ব্যয় করার মতো বাড়তি অর্থ বরাদ্দ রাখার সামর্থ্য আপাতত সরকারের নেই। ফলে সরকারের আন্তরিকতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বৃহৎ স্বার্থে এবার বাজেটে পে স্কেল ঘোষণার মতো সুখবরটি রাখা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের এই দাবিটি গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হতে পারে।’
বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অষ্টম বেতন কাঠামো কার্যকর রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে এই বেতন কাঠামো ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত পে-কমিশন বা বেতন কমিশন তখন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২০টি গ্রেডে বিভক্ত করে সপ্তম বেতন কাঠামো থেকে প্রায় শতভাগ বাড়িয়ে অষ্টম বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের সুপারিশ করে।
সরকার এই সুপারিশ অনুযায়ী পরে দুই ধাপে ওই পে-স্কেল বাস্তবায়ন করে, যা কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে। অষ্টম বেতন কাঠামো অনুযায়ী, স্কেলের সংখ্যা মোট ২০টি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ৭৮ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন ৮ হাজার ২৫০ টাকা।
সরকারি চাকরিজীবীরা বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করার কথা।
তবে তৎকালীন ড. ফরাস উদ্দিন কমিশন প্রতি পাঁচ বছর পরপর বেতন কমিশন যে পদ্ধতিতে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে তার প্রথা বাতিল করে এর পরিবর্তে ভারতের মতো বাজারদরের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি বছর যে হারে মূল্যস্ফীতি ঘটে, সেই হারে বেতন সমন্বয় করার সুপারিশ করেন।
কিন্তু সবশেষ বেতন কাঠামো ঘোষণার পর ইতোমধ্যে সাত বছর পার হয়েছে। এরপর আর কোনো পে কমিশন গঠন কিংবা নতুন পে স্কেল ঘোষণা তো দূরের কথা, প্রতি বছর যে হারে মূল্যস্ফীতি ঘটে, সেই হারে বেতন সমন্বয় করার সুপারিশও আর বাস্তবায়ন হয়নি।
জানা গেছে, ৮ম জাতীয় বেতন স্কেল প্রদানের পর গত ৫ বছরে বিদ্যুৎ-পানি, ওষুধ, চিকিৎসা ও গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। এর বিপরীতে সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ বছরে ৫ শতাংশ হারে মোট ২৫ শতাংশ বেতন বেড়েছে। অর্থাৎ জীবনযাত্রার সুষম ব্যয়ে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ। অতিসম্প্রতি জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বেড়েছে।
সব শেষ দাবির সপক্ষে ২০১৯ সালের মার্চ থেকে সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদ ও সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন নামে সারা দেশে সরকারি কর্মচারীদের দুইটি কেন্দ্রীয় সংগঠন নিয়ে ঐক্য তৈরি হয়। এখন সেই জোট প্রসারিত হয়ে ১৬টি সংগঠনের একটি শক্তিশালী মহাজোট বা ফোরামে পরিণত হয়েছে। যার নাম দেয়া হয়েছে সরকারি কর্মচারী দাবি আদায়ে ঐক্য ফোরাম।
আরআই
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন