• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

প্রাণের উৎসব মিলনের উৎসব

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৪, ২০২২, ০২:৫৮ পিএম

প্রাণের উৎসব মিলনের উৎসব

মু আ কুদ্দুস

প্রাণের উৎসব, মিলনের উৎসব পহেলা বৈশাখ। হাজার বছরের বাঙালিয়ানায় এটি শুভযাত্রার দিন। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব একটি বর্ষ শুরুর দিন রয়েছে। তাদের নিজস্ব নিয়মে সেটি পালন করে তারা। পাক-ভারতে মূলত বাঙালি ভাষাভাষীর মানুষ এই দিনটি নিয়ে আচার-আচরণে বেশকিছু গ্ৰাম্য নিয়ম মেনে চলে। অশুভকে তাড়িয়ে দিয়ে শুভকে বরণ করা হলো পহেলা বৈশাখের মূল বিষয়বস্তু। গ্ৰামে এখনও চাল ও অহর ডাল ভাজা, ইলিশ-পান্তা, শামুকের জলে চোখ ভেজানোর নিয়ম প্রচলিত। সবার প্রার্থন থাকে আগামী দিনগুলোয় তাদের ‘সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’।


চৈত্রের শেষ দিনে, বারুণী মেলা, হিন্দু সম্প্রদায়ের পুণ্যস্নান, গ্ৰামের ছেলে-যুবাদের শিকারে বের হওয়া- এমন কিছু সংস্কৃতি ছিল, যা আজও চলমান। পহেলা বৈশাখের দিন খাবার আয়োজনে রাখা হতো মাসকলাইয়ের ডাল, ছোট মাছের চচ্চড়ি, শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, রসুন ভর্তা, শিং মাছের ঝোল, টক ডাল, সজনেসহ আরও অনেক মুখরোচক খাবার। পাশে থাকতো আখের গুড় দিয়ে মুড়ি মুড়কি, বিন্নি ধানের খই, জিলাপি, বাতাসা ইত্যাদি। এগুলো ছিল আনন্দ আর উৎসবের একটা অংশ। এরপর বৈশাখের প্রথম দিন এবং চৈত্রের শেষ দিন হতো হাডুডু, ঘোড়দৌড়, চরকি, ফুটবল খেলা। পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা ছিল বাড়তি আনন্দের।



পহেলা বৈশাখ জমিদারদের খাজনা আদায়ের দিন নির্ধারিত থাকে। পুরনো খাতা বন্ধ করে খোলা হতো নতুন হিসাবের খাতা। থাকতো আপ্যায়নের আয়োজন। যাকে বলা হয়, ‘হালখাতা’। ব্যবসায়ীরা সেদিন বকেয়া টাকা তোলার জন্য এই আয়োজন করতেন। সারা দিন চলতো আপ্যায়ন এবং বকেয়া টাকা আদায় উৎসব। বাংলা নববর্ষে এপার বাংলা-ওপার বাংলার মানুষ একই নিয়মে উদযাপন করে। বাংলা ভাষাভাষী বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পহেলা বৈশাখ উদযাপনের নিয়মটা অন্যরকম। তারা তাদের নিজেদের সংস্কৃতিতে দিবসটি পালন করেন।



পহেলা বৈশাখ উৎসব শুরুটা হলো গ্ৰামাঞ্চলে। গ্ৰামীণ মেলা, খেলা ও নৃত্য-সংগীত ছিল পহেলা বৈশাখের মূল উৎস। কিন্তু সেটা আজ শহরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। বৈশাখ বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সমৃদ্ধ করেছে সাংস্কৃতিক উৎসব ও চেতনাকে। এটা এখন বাঙালিদের প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে। এখানে এসে সবাই এক হয়ে জীবনের স্বাদ খুঁজে নেন। সবাই এদিন হয়ে ওঠে হাজার বছরের বাঙালিয়ানায়। সব ধর্মের মানুষ জিইয়ে রেখেছে প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। মৈত্রী-সম্প্রীতির এক মহামিলন পহেলা বৈশাখ। বৈশাখী মেলা সব মানুষকে আনন্দ দেওয়ার জন্য এক স্থানে একই সুরে গেঁথে রাখে। প্রকৃতির পরিবর্তন সেটা বৈশাখে এসে দেখা যায়। নতুনভাবে সাজে বৃক্ষ লতাগুল্ম। বিকালে কখনও কালবৈশাখী নেমে আসে, পাল্টিয়ে দেয় পৃথিবী।



মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সেটি ৯৬৩ হিজরিতে। ফসলি সন নামে এই নিয়ম প্রবর্তন করেন সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণের পর। কালক্রমে বাংলা সন হয়ে যায়, ‘পহেলা বৈশাখ‘। এই থেকে হিজরি সনের ভিত্তিতে বছর গণনা শুরু হয়। তখন থেকে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করা হয়। পরদিন পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিক ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রজা ও পণ্য ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান, যাতে নতুন বছরে দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করে এ হালখাতা। ফলে ওই নিয়ম আজ সর্বজনীন হয়ে মহোৎসবে পরিণত হয়েছে।



পহেলা বৈশাখ নাগরিক জীবনের সেতুবন্ধন। বাঙালি জাতিকে একত্রিত করার মাধ্যম। সারা বিশ্বে বসবাসরত বাঙালিরা এই দিনে নিজের সংস্কৃতিতে খুঁজে পায়। পহেলা বৈশাখ বাঙালির শিকড়ের মিলনমেলা। এই উৎসব দেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে সহায়তা করে আসছে। পহেলা বৈশাখ বিশ্বাস, ভালোবাসা, হৃদ্যতা বাড়িয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। ১৪২৯ নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আর্কাইভ