লাইজুল ইসলাম
করোনাভাইরাসের মহামারির সময়ে টেলিমেডিসিন সেবার বিপুল উত্থান হয়েছে। ডিজিটাল মাধ্যমে অনেক চিকিৎসকই এখন সেবা দিচ্ছেন। অধিকাংশ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে হাসপাতালে কিংবা চিকিৎসকের চেম্বারে যেতে হচ্ছে না। এ ছাড়া অনেক চিকিৎসক চেম্বারে না গিয়ে অনলাইনে রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করছেন। অনেক চিকিৎসক ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগীকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই টেলিহেলথ সার্ভিস।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইন ১৬২৬৩ নম্বরে ফোন করে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। লকডাউন চলাকালে এর হার আরও বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের মার্চ মাস থেকে গতকাল শুক্রবার (২৮ মে) পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিনটি হটলাইন নম্বরে ফোন করে ২ কোটি ৮১ লাখ ৭৩ হাজার ১৬৭ জন সেবা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৭ জন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য বাতায়নের ১৬২৬৩ নম্বরটি। এই নম্বরে এক কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার ২৬০ জন স্বাস্থ্যসেবার জন্য ফোন করেছেন। আর জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইন ১০৬৫৫ নম্বরে স্বাস্থ্যসেবা পেতে ফোন করেছেন ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮০ জন। হটলাইনে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শ পেতে ফোনকলের ৭০ শতাংশ ছিল করোনা-সংক্রান্ত। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ করোনা পজিটিভ ছিলেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, হটলাইনের নম্বরগুলোতে ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ছয় সহস্রাধিক চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, করোনাকালে টেলিমেডিসিন সেবা অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই সেবা গ্রহণ করা যায়। করোনার আগে গড়ে তিন থেকে চার হাজার মানুষ টেলিফোনে সেবা গ্রহণ করতেন। কিন্তু গত বছর করোনার সংক্রমণ শুরুর পর প্রতিদিন ৫০ থেকে ৯০ হাজার মানুষ টেলিফোনে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শ পেতে ফোন করতেন। এখন অবশ্য সংখ্যাটা একটু কমেছে; প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ হাজার মানুষ ফোন করে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের হটলাইনের কার্যক্রমের সমন্বয়ক। এই শাখার পরিচালক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘মানুষের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই সেবা আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ জন্য একটি কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সেখানে ফোন করে মানুষ চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন। বিষয়টি চালু করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এ সংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এটি অনন্য ভূমিকা পালন করবে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইউকেএইডের অর্থায়নে সিনেসিস আইটির কারিগরি সহায়তায় স্বাস্থ্য বাতায়নের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে টেলিফোনে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বাতায়ন।
সিনেসিস হেলথের প্রধান নির্বাহী পরিচালক ডা. নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গত এক বছরে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা পেতে বেশি কল এসেছে। একজন প্রসূতি বুঝতে পারেন না, তিনি কীভাবে খাবার গ্রহণ করবেন। কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন? হঠাৎ করে পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য তিনি কোথায় যাবেন কিংবা কী ধরনের চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন- এসব জানতে চেয়ে ফোন আসে। অনেক সময় প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা দুর্গম এলাকা থেকেও ফোন আসে। ওইসব এলাকায় এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। হাতুড়ে চিকিৎসক কিংবা ওষুধ বিক্রেতার পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করে অনেকে সমস্যায় পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষ ফোন করে এই হটলাইন নম্বর থেকে চিকিৎসা পরামর্শ নিচ্ছেন। রোগীর স্বাস্থ্য সমস্যা শুনে একটি ব্যবস্থাপত্র তৈরি করে তা মোবাইলে এসএমএস করে পাঠানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। এতে করে রোগীরা উপকৃত হচ্ছেন।’
ব্র্যাক স্কুল অব পাবলিক হেলথের সাবেক ডিন আহমেদ মোশতাক রাজা চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে কোভিড একটি মহাসুযোগ এনে দিয়েছে। এই লক্ষ্যে আমাদের কী করতে হবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞজনেরা প্রায় সবাই একমত। এগুলোর মধ্যে আমি এ খাতের জন্য পাঁচটি সুপারিশের কথা উল্লেখ করতে চাই। এক, একটি স্বাস্থ্য কমিশন গঠন, যার কাজ হবে দেশব্যাপী কীভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করা যায়, তার রূপরেখা তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে নজরদারি করা; দুই, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিতকল্পে একটি ন্যাশনাল হেলথ সিকিউরিটি অফিস স্থাপন, যার কাজ থাকবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পারচেজার রোল এবং প্রভাইডার রোলকে আলাদা করা; তিন, সুশাসন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ; চার, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা পিএইচসির অগ্রাধিকার বাড়ানো, যার মাধ্যমে এখানে বিনিয়োগ বর্তমানের ২৫ ভাগ থেকে বেড়ে পর্যায়ক্রমে ৫০ ভাগে নিয়ে যাওয়া; পাঁচ, গবেষণায় উপযুক্ত বিনিয়োগ করা এবং এ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিভিন্ন সময় এই বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অধিকাংশ রোগীর হাসপাতালে আসার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অযথা হাসপাতালে ভিড় করছেন। টেলিহেলথ ও টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে হাসপাতালে ভিড় কমানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে হয়রানি ছাড়াই মানুষ ঘরে বসে চিকিৎসাসেবা পাবেন। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। টেলিহেলথ সেবাকে আরও যুগোপযোগী করে তোলা হবে।’
লাইজুল/এম. জামান/২৯ মে
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন