• ঢাকা সোমবার
    ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ০৮:৩৮ পিএম

এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি

মুনওয়ার আলম নির্ঝর

ভাষা আন্দোলন ৭০ বছর পার করে ফেলেছে। যে ভাষার জন্য এই লড়াই, সেই বাংলা ভাষা কতটা সর্বস্তরে চালু হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে নানা আলোচনা।

বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছরের অধিক পুরোনো। গত সহস্রাব্দের শুরুর দিকে পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। সুলতানি আমলে এ অঞ্চলের অন্যতম রাজভাষা ছিল বাংলা। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছিল বাংলা ভাষায়।

ধারণা করা হয়, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলায় রচিত সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পায়। বাংলা ভাষার লিপি হলো বাংলা লিপি। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংলা ভাষার মধ্যে শব্দগত ও উচ্চারণগত সামান্য পার্থক্য রয়েছে। বাংলার নবজাগরণে ও বাংলার সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিকে এক সূত্রে গাঁথা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে তথা বাংলাদেশ গঠনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।



১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত বাংলা ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ হলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিবিধ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আমরাও স্বাধীনভাবে বাংলায় কথা বলার সুযোগ পাই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলায় কথা বলার সে সুযোগ পাওয়ার পর এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সকল দাপ্তরিক কাজে বাংলাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা থাকলেও বাংলা কি আসলে সর্বস্তরে প্রচলিত হয়েছে?

বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য ১৯৮৭ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইন প্রণয়নের পর থেকে জাতীয় সংসদের সকল আইন বাংলা ভাষায় প্রণীত হচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব ও অন্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তা হলে সে আবেদন বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।

এই অঞ্চলে বাংলাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হলেও বেশ লম্বা সময় ধরে বাংলাকে বিবেচনা করা হতো নিম্ন শ্রেণির ভাষা হিসেবে। সাহেবি ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে বিবেচনা করা হতো। কোলকাতা কেন্দ্রিক যে শিক্ষিত সমাজটি গড়ে উঠেছিল তৎকালীন সময়ে তাদের বেশিরভাগ কথা বলতেন ইংরেজিতে। শিক্ষকরা ক্লাসে লেকচার দিতেন ইংরেজিতে। ছাত্রদের তর্ক-বিতর্ক এমনকি পরীক্ষার খাতায় ইংরেজিতে লেখাকে উৎসাহিত করা হতো।

মেধাবী ও তুলনামূলক সুবিধাজনক শ্রেণি বাংলাকে নিজের ভাষা হিসেবে নিতে পারেনি কখনই। অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকেও যত সাহিত্য চর্চা হতো তার ভিতরে কেউ কেউ ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করতে চাইতেন। মধুসূদন দত্ত এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জানা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ও প্রথম দিকে ইংরেজিতে তার লেখা চালাতে চেয়েছিলেন।



লেখক ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর একটি লেখায় দাবি করেছেন, দেশের শাসকশ্রেণি বাংলা ব্যবহারে আগ্রহী নয়। তার মতে, অতীতে আমরা পরাধীন ছিলাম, বিদেশিরা আমাদের শাসন করেছে, তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করবে না বরং তাদের নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। এ জন্য আমরা দেখেছি সংস্কৃত, ফার্সি এবং পরে ইংরেজি হয়েছে সরকারি ভাষা, বাংলা ভাষা সে মর্যাদা পায়নি।

তিনি বলেন, ‘বাংলার প্রচলনের অন্তরায় অন্য কেউ ঘটাচ্ছে না, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে দেশের বিদেশমুখো ও বিদেশ প্রভাবিত শাসকেরাই ঘটাচ্ছে। শাসকশ্রেণির ভেতর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা পেশাজীবী, সবাই আছে। তাদের প্রধান যোগ্যতা তারা ধনী। এরা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারলে খুশি হয় এবং যখন বাংলা ব্যবহার করে তখন মনমরা থাকে এবং ভাষাকে বিকৃত করে।’

তিনি মনে করেন বাংলা ভাষার লিখিত রূপেও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। তার মতে, বাংলা ভাষায় উচ্চারণের সঙ্গে লিখিতরূপের নৈকট্য। আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি সেভাবে লিখে থাকি। কিন্তু অধুনা দেখা যাচ্ছে কেবল উচ্চারণে নয় লিখিত রূপের ওপরও নিদারুণ হস্তক্ষেপ ঘটছে। প্রমিতকরণের নাম করে ‘ ী’ কারগুলোকে যাবজ্জীবন নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। সর্বাধিক অগ্রহণযোগ্য ‘শ্রেণী’ বানানে ‘ি’ কারের প্রয়োগ তার উদাহরণ।

এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপন নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই শীক্ষক। তিনি মনে করেন, দুর্দশাটা এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপনের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। আয়োজনের অভাব নেই, কিন্তু একুশের উদযাপনে মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে, সেটা হলো মধ্যরাতে উদযাপনের সূচনাকরণ। বাঙালির উৎসব শুরু হয় সকালে, ইউরোপীয়দেরটা মধ্যরাতে। ওদের মধ্যরাত আক্রমণ করেছে আমাদের সকালবেলাকে। যা ছিল স্বাভাবিক তাকে কৃত্রিম করে দেওয়ার আয়োজন বৈকি!

বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম মনে করেন সর্বস্তরে বাংলা চালু না হওয়ার পেছনে সরকারের উদ্যোগের অভাব এবং জনগণের অনীহাকেই মূল কারণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখনও উচ্চ শিক্ষার ভাষা, উচ্চ আদালতের ভাষা ইংরেজি৷ কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিলে না ৷ কথা ছিলো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হবে ৷ কিন্তু হয় নি ৷



সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের জন্য সরকারকে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে তেমনি বেসরকারি পর্যায়েও উদ্যোগ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি ৷ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়ার কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম ৷ তিনি আরও মনে করেন যে, ভাষা নিয়ে আমাদের দেশে এখনও এক ধরনের হীনম্মন্যতা রয়ে গেছে ৷ এই হীনম্মন্যতা দূর করতে হবে ৷

বাংলা নিয়ে আলোচনা, তর্ক, বিতর্ক কেবল ফেব্রুয়ারি এলেই করি। বছরের অন্য সময় আমরা চুপ থাকি এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাভাষার প্রচলন নিয়ে তর্ক চালাতে হবে সারা বছর। ঘরে-বাইরে সব জায়গায় জোর দিতে হবে বাংলাকে শুদ্ধভাবে আয়ত্ত্বের ওপর। নাটক, সিনেমায় আজকাল যে বিকৃত বাংলা বলার প্রচলন হয়েছে কথা বলতে হবে তার বিরুদ্ধেও। যেখানেই বিকৃতি সেখানেই প্রতিরোধ করতে হবে।

বাংলা আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয়। এই পরিচয়কে নষ্ট করে দেয়া মানে আত্মপরিচয়কে বিকৃত করা। ভুলভাল ইংরেজি বলতে পারাকে গর্ব নয়, শুদ্ধ বাংলা বলাকেই যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পরিবার থেকে প্রশাসন- সব জায়গায় চালু করতে হবে শুদ্ধ ও পরিশীলিত বাংলা ভাষা। বাংলা নিয়ে গবেষণার ওপর আরও বেশি জোর দিতে হবে। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করতে হবে বাংলা একাডেমির মতো ভাষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
আর্কাইভ