প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২, ০৮:০১ পিএম
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফ ও জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো
নাকানোর দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে বিরোধের জেরে জিম্মার বিষয়টি পারিবারিক আদালতে
নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রায় বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। এই সময়ে শিশুরা তাদের মায়ের
কাছে থাকবে এবং মা নাকানো এরিকো শিশুদের নিয়ে দেশত্যাগ করতে পারবেন না। বাবা
ইমরান শরীফ শিশুদের সঙ্গে সুবিধাজনক সময়ে দেখা করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন আদালত।
রবিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুই শিশুর জিম্মা নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল করে
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চ
এ আদেশ দেন।
একই সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতকে দুই শিশুর
জিম্মা সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে বলেছেন আদালত।
আদালতে মায়ের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন
কিউসি ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করীম। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।
আর বাবার পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ফিদা এম কামাল, আইনজীবী ফাওজিয়া
করিম ফিরোজ ও অনীক আর হক। তাদের সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার মারুফুল ইসলাম।
দুই মেয়েকে নিজের জিম্মায় পেতে ঢাকায় এসে গত ১৯ আগস্ট জাপানি মা নাকানো এরিকোর
করা রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট কয়েক দফায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে দুই
মেয়েকে তাদের বাবা ইমরান শরীফের হেফাজত থেকে সিআইডি উদ্ধার করে ভিকটিম সাপোর্ট
সেন্টারে রাখে। পরে দুই পক্ষের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ইমরান শরীফের গুলশানের ভাড়া
করা ফ্ল্যাটে দুই শিশুকে নিয়ে বাবা-মা কিছুদিন একসঙ্গে থাকেন। এরপর হাইকোর্ট দুই শিশুর
সঙ্গে তাদের বাবা-মাকে থাকার সময় ভাগ করে দিয়ে কয়েকবার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া হাইকোর্ট
দু’পক্ষকেই কয়েকবার সমঝোতায় বসার সুযোগ দেন।
কিন্তু সমঝোতা না হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত বছরের ২১ নভেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর
রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ দুই শিশুর জিম্মা নিয়ে
করা রিটটি (কন্টিনিউয়াস ম্যান্ডামাস) বিচারিক বিবেচনায় চলমান থাকবে বলে রায় দেন।
সেই রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘আমরা দুপক্ষের আইনজীবীকেই আন্তরিক ধন্যবাদ
জানাব কোর্টকে সহযোগিতা করার জন্য। এ ধরনের একটা কন্টেস্টিং মামলায় দুপক্ষেই
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ল উপস্থাপন করেছেন, যাতে আমরা সমৃদ্ধ
হয়েছি এবং যা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব সহায়ক হয়েছে। তবে হৃদয়বিদারক কথা হচ্ছে, আমরা আজ যে রায় বা আদেশ দিই না কেন, ভিকটিম কোনো না
কোনো পক্ষ তো হবেন। তার চেয়ে বেশি ভিকটিম হবে এই দুই শিশুসন্তান।
আমরা আশা করব, এই বাবা-মা ভবিষ্যতে যেন আরও গঠনমূলক এবং
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করেন এবং সেক্ষেত্রে তারা যাতে পদক্ষেপ নিতে পারেন, আমরা সে সুযোগ রেখেই আদেশটি দিচ্ছি। আরেকটি কথা বলতে
হবে যে, আমরা আপনাদের সিদ্ধান্ত এবং যুক্তি সবকিছুই
যতটুকু সম্ভব বিবেচনা করেছি। এসব বিবেচনা করতে গিয়ে আমরা শিশু দুটির সঙ্গে সর্বমোট
তিনবার কথা বলেছি। আমরা আমাদের বিবেচনায় বাচ্চাদের বর্তমান পর্যায়ে কল্যাণের জন্য
যে ধরনের আদেশ প্রদান করা সমীচীন,
সেভাবেই আদেশ দিচ্ছি।’
এরপর হাইকোর্ট তার রায়ে বলেন,
‘যেহেতু মা জাপানি নাগরিক, সেখানে তার বসবাস ও কর্মস্থল, সে কারণে তিনি তার সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশে এসে
শিশুদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বছরে
তিনবার বাংলাদেশে তার যাওয়া-আসাসহ ১০ দিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ শিশু দুটির বাবাকে
বহন করতে হবে। এর চেয়ে অতিরিক্ত যাওয়া-আসা বা বাংলাদেশে অবস্থানের ক্ষেত্রে খরচ
মা নিজে বহন করবেন। এ ছাড়া বাবা মাসে কমপক্ষে দুই বার শিশু সন্তানদের ভিডিও কলে
মায়ের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবেন।’
সেই রায়ে গত কয়েক মাস বাংলাদেশে অবস্থান ও যাতায়াত বাবদ মাকে ১০ লাখ টাকা সাত
দিনের মধ্যে দিতে শিশুদের বাবার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা
কর্মকর্তাকে এই শিশুদের দেখভাল অব্যাহত রাখতে এবং প্রতি তিন মাস পরপর শিশুদের
বিষয়ে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর প্রতিবেদন দিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন। আর
জাপানে থাকা আরেক মেয়েকে হাইকোর্টে হাজিরের নির্দেশনা চেয়ে ইমরান শরীফের করা রিটটি
খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে মা নাকানো এরিকো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন। সে আবেদনের শুনানি আপিল বিভাগ দুই শিশুকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দেন। তবে বাবা ইমরান শরীফকে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে শিশুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়। অতঃপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে জাপানি মায়ের করা আপিলের শুনানি শেষে রবিবার রায় দিলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।
অর্ণব/ফিরোজ