লাইজুল ইসলাম
লাইসার্জিক এসিড ডাই-ইথালামাইড বা এলএসডি এক ধরনের তরল। ব্লটিং পেপারে সংরক্ষণ করা হয়, যা দেখতে ডাকটিকিটের মতো। এই ভয়ংকর মাদক সেবনে এতটাই বিভ্রম তৈরি হয় যে সেবনকারী নিজেকে প্রচণ্ড শক্তিশালী মনে করে। কিছুতেই কিছু হবে না—এমন বেপরোয়া মনোভাব থেকে সেবনকারী হয়ে ওঠে আত্মঘাতী।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও এলএসডির ইতিহাস ঘেঁটে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পেরেছে, এলএসডিসেবীরা নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবেন। সেবনকারী চিন্তা করেন তিনি বুঝি পরির মতো উড়তেও পারবেন। তার স্মৃতি চলে আসে মানসপটে, ভেসে বেড়ায়। এটি সেবনের পর কারও কারও এমন অস্বাভাবিক মানসিকতা হয় যে, মনে করেন তিনি বুঝি ট্রেন পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে দিতে পারবেন। এটি ব্যবহারে যে কারও মাথা ভার হয়ে যাবে। হেলোজেনিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ যদি গান শোনেন, তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রঙের মতো ঘুরতে থাকে। এগুলো স্রেফ মায়াজাল, এক ধরনের কাল্পনিক বিভ্রম। এলএসডি সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে। একটি এলএসডি ব্লট সেবন করলে ৮-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকে। অতিরিক্ত সেবনে ২০ ঘণ্টা পর্যন্তও প্রতিক্রিয়া হয়।
ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনে এলএসডি সম্পৃক্ত কি-না? প্রশ্ন রাখা হলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, সম্প্রতি হাফিজুর রহমান নামে ঢাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় ডিবি তদন্ত শুরু করে। হাফিজের বন্ধুরা বলেছে, হাফিজ একটি নতুন ও অদ্ভুত মাদকে আসক্ত ছিল। এর পরই এলএসডির বিষয়ে তথ্য পেয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, হাফিজুরের মৃত্যুর পেছনে এলএসডির সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে আত্মহত্যা করা হাফিজুরের লাশের ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর বলা যাবে, তিনি এলএসডিতে আসক্ত ছিল কি-না।
ডিবি সূত্র সিটি নিউজ ঢাকাকে জানিয়েছে, সাদমান সাকিব বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম এ মাদক অর্ডার করেন। মাদকের জন্য তারা অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেন (পেমেন্ট) ব্যবস্থা পেপ্যালে টাকা পরিশোধ করলে পার্সেলের মাধ্যমে এই মাদক আসে। সুইডেন থেকেও এলএসডি মাদক আমদানি করা হয়। গত ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তার তিন বন্ধু (গ্রেফতার) এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে হাফিজ শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এর পর ঢামেক হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন। গলার রগ ছিড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লেও আহত হাফিজুরের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। একটু টালমাটাল অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে হেঁটে চলতে দেখা যায় তাকে।
ডিবির ওই সূত্র আরও জানায়, ফেসবুকে ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি গ্রুপের মাধ্যমে ওই মাদকের ক্রেতা সংগ্রহ করা হয়। গ্রুপে সদস্য সংখ্যা এক হাজারের বেশি। গ্রেফতারকৃত রূপল গ্রুপটি পরিচালনা করেন। রূপল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর ছাত্র ছিলেন। ড্রপ আউট হওয়ার পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি মাদক আমদানি করা হয়। অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেন (পেমেন্ট) ব্যবস্থা পেপ্যালের মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়। এই তিনজনের কাছ থেকে ২০০টি এলএসডি জব্দ করা হয়েছে। প্রতিটি তিন হাজার টাকা মূল্যে তারা বিক্রি করেন।
ডিবি পুলিশের দাবি, যে তিন বন্ধু হাফিজুর রহমানকে এলএসডি সেবন করিয়েছেন, তারা পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন। তিনজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি সূত্র বলছে, নানাভাবে এলএসডি বাজারজাত করা হয়। যেমন : ব্লটার পেপার বা নকশা করা বিশেষ কাগজে এলএসডি মেশানো হয়। এভাবেই এলএসডি বেশি সহজলভ্য। এ ছাড়া ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল আকারে, তরল বা কিউব আকারে পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই বছর আগে রাজধানীতে এলএসডি নামক (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) মাদক জব্দ করে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। মহাখালী থেকে ওই সময় এলএসডি সেবন ও বিক্রির অভিযোগে দুই তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। তখন ওই দুই তরুণের বয়স ছিল ২০ বছর।
তারা আরও জানায়, এলএসডি নতুন কোনো মাদক নয়। বাংলাদেশে এই মাদকের ব্যবহার বহু বছর আগেই শুরু হয়েছে। তবে এর ব্যাপক বিস্তার হয়নি। কেননা, এই মাদকের দাম বেশি এবং এটি ইউরোপের দেশ থেকে বাংলাদেশে এসেছে। নব্বইয়ে দশকে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দেশে আসায় এলএসডির ব্যবহার সেভাবে দেখা যায়নি। তবে ৩-৪ বছর ধরে কিছু কিছু তরুণের মধ্যে এই মাদক নেয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
তথ্য বলছে, তারা মহাখালী ডিওএইচএস থেকে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই এলএসডিসহ দুজনকে হাতেনাতে ধরেন। এ ঘটনায় কাফরুল থানায় একটি মামলাও হয়। মামলা নম্বর ২১। গ্রেফতার করা হয় রেদোয়ান আনান ও সৈয়দ আহনাদ আতিফ মাহমুদ নামে দুজনকে। ডিএনসির সুপারিনটেনডেন্ট ফজলুল হক খান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করেন পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান। তদন্তের পর ২০২০ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এখন মামলাটি বিচারাধীন আছে।
ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, ‘এখন যেহেতু একটা তথ্য পাওয়া গেছে, কেউ কেউ বাজার তৈরির চেষ্টা করছে, আমরা নজরদারি বাড়াব।’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পার্সেলে অন্য ধরনের মাদক পাচার আমরা ধরেছি। এ কারণে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞরা জানান, সাধারণত এলএসডি নেয়ার পর একজন মানুষ চোখ বন্ধ করেও দেখতে পায়। তার দেখা এসব দৃশ্য সব সময় বাইরের পৃথিবী বা স্মৃতি থেকে আসে না বরং তাদের কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে যায়। এলএসডির প্রভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এলএসডি নেয়ার পর প্রকৃতি ও বাইরের জগতের সঙ্গে এমন এক সম্পর্ক অনুভূত হয়, যাকে অনেক সময় আধ্যাত্মিক রূপ দেয়া হয়ে থাকে। এই মাদকের প্রভাব কেটে গেলেও ওই রকম অনুভূতি থেকে যেতে পারে।
এলএসডি কী?
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনস্থ মাদকবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য অনুযায়ী, ডি-লাইসার্জিক অ্যাসিড ডায়েথিলামাইড বা এলএসডি রাসায়নিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি একটি পদার্থ যা রাই এবং বিভিন্ন ধরনের শস্যের গায়ে জন্মানো এক বিশেষ ধরনের ছত্রাকের শরীরের লাইসার্জিক অ্যাসিড থেকে তৈরি করা হয়।
এটি স্বচ্ছ, গন্ধহীন একটি পদার্থ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের মতে এটি পাউডার, তরল, ট্যাবলেট বা ক্যাপসুলের আকারে পাওয়া যায়।
এলএসডিকে 'সাইকাডেলিক' মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধরনের মাদকের প্রভাবে সাধারণত মানুষ নিজের আশেপাশের বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে এবং কখনো কখনো 'হ্যালুসিনেট' বা অলীক বস্তু প্রত্যক্ষও করে থাকে।
এলএসডি কেন ক্ষতির কারণ হতে পারে?
ইউরোপের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট রিসার্চগেইট'-এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয় এলএসডি গ্রহণের পরবর্তী জটিলতায়।
বিষণ্নতা বা দুশ্চিন্তায় ভোগা ব্যক্তিরা এলএসডি গ্রহণের পর আরও বেশি বিষণ্নতা বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে পারেন বলেও উঠে এসেছে অনেক গবেষণায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলছে, এলএসডি গ্রহণের পর অনেকে মনে করেন যে তিনি সবকিছু পরিষ্কার দেখছেন এবং তার শরীরে অতিমানবিক শক্তি এসেছে। এরকম বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার ফলেও অনেকে নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।
অতিরিক্ত আতঙ্কের কারণে মানুষ অনেক সময় মনে করতে পারে যে সে শিগগিরই মারা যাবে বা মারা যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতেও মানুষ আতঙ্কের বশবর্তী হয়ে নানা ধরনের কাজ করে থাকে যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
আতঙ্কিত হওয়ার পাশাপাশি অতি দ্রুত অনুভূতির পরিবর্তন হওয়ার কারণেও মানুষ মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করতে পারে বলে বলছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন।
লাইজুল/এএমকে/২৮ মে/২০২১
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন