প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২২, ০৯:০৬ এএম
বর্ষবরণের রাতে আতশবাজি ফুটাতে যখন ব্যস্ত ছিল সবাই, এদিকে বাজির শব্দে সারারাত ঘুমাতে পারছিলনা শিশু উমায়ের। তার পরিবার থেকে জানা
যায়, বিকট শব্দে বারবার ভয়ে আঁতকে উঠছিল তাদের
চারমাস বয়সী ওই শিশু সন্তান। ছেলে শিশুটিকে স্বাভাবিক রাখতে তার বাবা-মা আপ্রাণ
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। শিশুটির সারাটা রাত কাটে এমন আতংকে, এক পর্যায়ে শুরু হয় শ্বাসকষ্ট। পরদিন (১ জানুয়ারি) তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা
হলে সেখানে দুপুরের দিকে মৃত্যু হয় শিশু তানজিন উমায়েরের।
হাসপাতাল থেকে দেওয়া সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'সাডেন হার্ট
ফেইলিওর' উল্লেখ করা হয় এবং জন্মসূত্রে শিশুটি হৃদরোগে
আক্রান্ত ছিল বলে পরিবার জানায়।
উমায়েরের বাবা ইউসুফ রায়হান শিশুর ছবিসহ ৩১ জানুয়ারি রাত ১২টার আগে ফেসবুকে
লেখেন, ''কী বিকট শব্দে আতশবাজি। আমার ছোট বাচ্চাটি
এমনিতেই হার্টের রোগী। আতশবাজির প্রচণ্ড শব্দে শিশু বাচ্চাটি আমার ক্ষণে ক্ষণে
কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুবই আতঙ্কের মধ্য দিয়ে সময়টা পার
করছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সন্তানদের বুঝ দান করুক। দোয়া করা ছাড়া আর কোনো
উপায় নেই।''
এরপরই তার এ পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিনের থার্টি ফার্স্ট নাইটের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন উমায়েরের বাবা
ইউসুফ। গণমাধ্যমে এমন সন্তান হারানোর শোকাবহ ঘটনা বর্ণনার পর তিনি চোখে পানি ধরে
রাখতে পারেননি। রায়হান বলেন,‘শুক্রবার রাতে ছেলেটা বেশ সুস্থ ও প্রাণবন্ত
ছিল। সে সন্ধ্যায় মনের আনন্দে খেলাধুলা করছিল। সন্ধ্যায় তার মা আমাকে ভিডিও কল করে
ছেলেটাকে দেখাল। উৎফুল্ল ছেলেকে দেখে আমিও বাসায় ফিরে আসি। বাসায় ফিরে দেখি
উমাইয়ারের মা তাকে খাওয়াচ্ছে। রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে পটকা ও আতশবাজি
ফাটানো শুরু হলো। ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে পটকা ফাটানোর অনেক শব্দ
হচ্ছিল। আতশবাজির বিকট শব্দে বারবার কেঁপে উঠছিল ছেলেটি। তার সামনে যেতেই ভয়ে
আঁতকে উঠছিল, দূরে সরে যাচ্ছিল।
আমি তখন উমায়েরের মাকে বলি ওকে জড়িয়ে ধরতে, যাতে বিকট
শব্দগুলো তার কানে না যায়। আমরা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুঝতে পারছিলাম শ্বাস নিতে
কষ্ট হচ্ছিল তার। কোনোভাবে রাতটি অতিক্রম করলাম। সকালে শ্বাসকষ্ট বেশি হওয়ায় আমরা
তাকে হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাই। চিকিৎসক দেখে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভর্তি নেন। দুপুর
পর্যন্ত তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল,
বিকেলে তাকে আইসিইউতে
নেওয়া হলো। এর পরপরই তাকে নেওয়া হলো লাইফ সাপোর্টে। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ পর ডাক্তার
আমাদের ডেকে বললেন ছেলেটা হার্টফেল করেছে, সে আর বেঁচে
নেই।’
ঘটনা বর্ণনার পর তিনি বলেন,
‘আমার বাবু মায়ের পেট
থেকেই হৃদযন্ত্রে ছিদ্র নিয়ে এসেছিল। প্রথমে রোগ ধরতে না পারলেও আমরা বিভিন্ন
হাসপাতালে তার টেস্ট করাই। অবশেষে রোগ শনাক্ত করতে পেরে চিকিৎসকরা ফেব্রুয়ারিতে
তার অপারেশনের ডেট দেন। উমায়েরের শ্বাসকষ্টও ছিল। সে অল্প শব্দেই কেঁপে উঠত, ভয় পেত।’
ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে নিউমোনিয়া নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে ভর্তি করা হয় উমায়েরকে। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ন্যাশনাল হার্ট
ফাউন্ডেশনে ভর্তি করা হয় তাকে। চার দিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় আসে। বাসায় ফিরে
সপ্তাহখানেক পর আবার তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তাকে ডাক্তার
দেখানোর কথা ছিল। ডাক্তারের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে তাকে দেখানো যায়নি।
ডাক্তার উমায়েরকে ১ তারিখে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
ইউসুফ রায়হান বলেন, আমি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পারি আল্লাহ
তার বান্দাকে নিয়ে গেছেন। সত্যিই অতিরিক্ত শব্দের কারণেই তার হার্টফেল হয়েছিল কি
না, আমরা তা বলতে পারব না। তবে সেই বিকট শব্দের
কারণে বার বার কাঁপতে থাকা ছেলেটির সেই মুহূর্তের চেহারা কিছুতেই ভুলতে পারছি না।
শুধু মনে হচ্ছে, আতশবাজির শব্দে আমার বাচ্চাটার অনেক কষ্ট হয়েছে, আমরা তার কষ্ট কমাতে পারিনি। তারপরও সবার প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে এভাবে শব্দ
করে আতশবাজি ফাটালে বিশেষত যারা হৃদরোগে আক্রান্ত তাদের অনেক সমস্যা হয়। আমরা
সুস্থরাও অনেক সময় বাজি ফাটার শব্দে চমকে উঠি।
তিনি জানান, তার স্ত্রী এবং আরেকটি পাঁচ বছরের সন্তান
রয়েছে। তারা মোহাম্মদপুরে থাকেন। তিনি একটি ছোট দোকান চালান। তাদের বাড়ি ময়মনসিংহ।