প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৫, ২০২১, ০৯:২৮ পিএম
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে যেভাবে আগুন
লাগতে পারে, তা নিয়ে কথা
বলেছেন লঞ্চটির মালিক ও কর্মীরা।
লঞ্চকর্মীরা মনে করছেন ইঞ্জিনকক্ষ থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড থেকে এমন বড় ঘটনা
ঘটতে পারে। এদিকে লঞ্চটির মালিক বলছেন, ‘গত অক্টোবর মাসে ইঞ্জিন বদলানো হয়েছিল। তবে সে জন্য নৌপরিবহন অধিদফতর থেকে
অনুমতি নেয়া হয়নি।
নৌপরিবহন অধিদফতরের সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশিদ বলেন, ‘লঞ্চের কাঠামোগত পরিবর্তন বা ইঞ্জিন পরিবর্তন
করতে হলে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন পরিবর্তনের আগে আমাদের
কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি।
বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশে রওনা
হয় এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চটি। দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ঝালকাঠি শহরের কাছাকাছি
পৌঁছানোর পর সুগন্ধা নদীতে থাকা অবস্থায় তিনতলা লঞ্চটিতে হঠাৎ আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
দ্রুতই আগুন পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। শীতের রাতে লঞ্চের বেশির ভাগ যাত্রী তখন ঘুমিয়ে
ছিলেন। ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। শতাধিক যাত্রী দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন। হতাহত যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও সূত্রপাত :
ফায়ার সার্ভিসের বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক কামাল হোসেন ভূঁইয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি নিশ্চিত হয়ে বলেন, ‘লঞ্চটির
ইঞ্জিনকক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। একই রকম
বক্তব্য দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী লঞ্চের যাত্রী জাহিদুল ইসলাম।’
তিনি বলেন, ‘রাত পৌনে একটায়
বরিশাল নৌবন্দর ত্যাগ করার পর লঞ্চটির পুরো ডেক উত্তপ্ত হয়ে যায়। শীত ও কুয়াশার
কারণে ডেকের চারপাশ ত্রিপল দিয়ে আটকানো ছিল। রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠি
স্টেশন থেকে দেউরী এলাকায় পৌঁছতেই আগুন লাগে। কিছুটা দূরে এলে ইঞ্জিনকক্ষে আগুন
ধরে যায়। এরপর পুরো লঞ্চের মধ্যে আগুন
ছড়িয়ে পড়ে। তার দাবি, লঞ্চের নিচতলার
ইঞ্জিনকক্ষের পাশে ডিজেলভর্তি ড্রাম, কয়েকটি রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার ও দুটি মোটরসাইকেল ছিল। আগুন ছড়িয়ে পড়ার
ক্ষেত্রে এসব দাহ্য পদার্থের ভূমিকা আছে বলে মনে করছেন।’
ইঞ্জিনকক্ষে তিনটি তেলের ট্যাংকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার লিটার তেল ছিল জানিয়ে
এমভি অভিযান-১০-এর মালিক হামজালাল শেখ
বলেন, ‘আগুন নিভে যাওয়ার পরও তেল
থাকার কারণে ইঞ্জিনকক্ষের আগুন আরও দুই ঘণ্টা জ্বলে।’
অন্যদিকে, বিআইডব্লিউটিএর
বরিশাল অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের কারণ তদন্ত করার জন্য নৌপরিবহন
মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ পৃথক দুটি তদন্ত
কমিটি করেছে। কীভাবে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার আগে কোনো
মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে স্থানীয়দের অভিমত :
লঞ্চটিতে আগুন লাগার পর তীরে ভেড়াতে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় লেগেছিল বলে জানায়
স্থানীয় প্রতক্ষদর্শীরা। তারা মনে করছেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই লঞ্চটিকে তীরে ভেড়ানো সম্ভব হলে প্রাণহানি অনেকাংশ
এড়ানো যেত।
একজন লঞ্চমালিকের বক্তব্য, 'বেশির ভাগ লঞ্চে
রিকন্ডিশন্ড বা পুরোনো ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। এগুলো মূলত সমুদ্রগামী জাহাজের
জেনারেটর ইঞ্জিন। ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিলে ও তা না সারাতে পারলে প্রচুর তাপমাত্রা
উৎপন্ন হয়।'
অভিযান-১০-এর অনুমোদনহীন ইঞ্জিন বদল ও লঞ্চ
মালিকের মন্তব্য :
অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ বলেন, ‘আগের ইঞ্জিন দুটিতে ত্রুটি থাকায় গত অক্টোবর
মাসে ইঞ্জিন বদলানো হয়। ডকইয়ার্ডে উঠিয়ে ৭২০ অশ্বক্ষমতার দুটি ইঞ্জিন লাগানো হয়।
এভাবে ইঞ্জিন লাগানো যায় কিনা, জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদফতরের সার্ভেয়ার মাহবুবুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন,
‘লঞ্চের কাঠামোগত পরিবর্তন
বা ইঞ্জিন পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন
পরিবর্তনের আগে আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি।’
এ ধরনের অনুমতি নেয়া হয়েছে কিনা, তা জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ।
এমভি অভিযান-১০–এর ফিটনেস সনদে দেয়া তথ্যানুযায়ী, এতে ২০টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ১টি বালুর বাক্স, ১৫টি ফায়ার বাকেট ও ১টি পানির পাম্প ছিল।
মালিক হামজালাল শেখ বলেন, ‘আগুন দ্রুত ছড়িয়ে
পড়ায় এসব কোনো কাজে আসেনি। তবে লঞ্চের কর্মীদের অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ছিল
কিনা, তা বলতে পারেননি হামজালাল
শেখ।’
ফিটনেস সনদ অনুযায়ী, এমভি অভিযান-১০
লঞ্চটি ২০১৯ সালে নির্মাণ করা হয়। এটির দৈর্ঘ্য ৬৪ মিটার ও গভীরতা ২ দশমিক ৮০
মিটার। বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদফতরে লঞ্চটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০১-২৩৩৯।
ঢাকা-বরগুনা নৌরুটে বর্তমানে ছয়টি লঞ্চের রুট পারমিট রয়েছে। মেসার্স আল আরাফ
অ্যান্ড কোম্পানির এমভি অভিযান-১০ ছাড়া বাকি লঞ্চগুলো হচ্ছে মেসার্স খান ট্রেডার্স
ও মেসার্স সুরভী পরিবহনের যৌথ মালিকানায় রাজারহাট-বি, পূবালী-১, শাহরুখ-২ ও রাজহংস-৮, এমভি ফারহান–৮। এমভি ফারহান–৮ লঞ্চটির মালিক
জাতীয় পার্টির সাংসদ গোলাম কিবরিয়া।
যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতিযোগিতায়
টিকে থাকতে ও অধিক মুনাফার জন্য মালিকেরা রোটেশন পদ্ধতিতে লঞ্চ পরিচালনা করেন। এ
পদ্ধতির কারণে যাত্রীর চাপ থাকলেও প্রতিদিন উভয় প্রান্ত থেকে মাত্র দুটি লঞ্চ
চালানো হয়।