
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০২১, ০৮:০৯ পিএম
কুষ্টিয়ার ছেলে
আবরার থাকতেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। মামলার নথিপত্র ও আসামিদের
দেয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তির তথ্য অনুযায়ী, আবরার হত্যার
মূল হোতা বা সূচনাকারী হিসেবে তার রুমমেট মিজানুর রহমানকে চিহ্নিত করে পুলিশ।
মিজানুর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিনকে
বলেছিলেন, আবরারকে তার শিবির বলে সন্দেহ হয়।
পরে রবিন
বুয়েটের শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের ১৫ ও ১৬তম ব্যাচের যে ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ ছিল,
সেখানে
একটি পোস্ট দেন। পরদিন ৫ অক্টোবর হলের গেস্টরুমে (অতিথি কক্ষে) কয়েকজন মিলে সভা
করেন।
আবরারকে হত্যার
দায় স্বীকার করে আটজনের দেয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে,
তাকে
কত নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
অনিক সরকারের
জবানবন্দি :
আবরারকে পিটিয়ে হত্যায় সবার আগে আসে অনিক সরকারের নাম। অনিক বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি শেরেবাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ছিলেন। অনিক ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ‘সেদিন হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ইফতি মোশাররফ আবরারকে একটা ভাঙা ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটাচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে আমিও আবরারের হাতে ও পায়ে ৪০ থেকে ৫০ বার ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আঘাত করি। আমি দুই দফা আবরারকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে প্রায় শতাধিকবার আঘাত করি। রাত ১টা ২০ মিনিটে রবিন আমাকে জানায়, আবরার বমি করছে।’
ইফতি মোশাররফের
জবানবন্দি :
যে কক্ষে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, সেই কক্ষে থাকতেন ইফতি মোশাররফ। তিনি বুয়েটের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। ইফতি আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমরা সবাই মিলে আবরারকে প্রশ্ন করতে থাকি, সে (আবরার) শিবির করে কি না? আর কে কে শিবির করে? আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য তাকে চার থেকে পাঁচটা বাড়ি দেই। এতে স্টাম্পটা ভেঙে যায়। পরে অনিক আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল আর চড় মারছিল। অনিক আবরারের হাঁটু, পায়ের তালু, বাহুতে স্টাম্প দিয়ে মারতে থাকেন। মুজাহিদও স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারতে থাকেন। অনিক আবার রাত ১১টার সময় রুমে আসে। তখনও সর্বশক্তি দিয়ে আবরারকে মারতে থাকেন অনিক।’
মেহেদী হাসান
রবিনের জবানবন্দি :
বুয়েটের
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়তেন মেহেদী হাসান রবিন। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে
মেহেদী বলেন, ‘২০১৯ সালের ২ অক্টোবর থেকে ৪ অক্টোবরের মধ্যে
যেকোনো একদিন ১৬তম ব্যাচের ছাত্র মিজানুর তাকে জানিয়েছিলেন, তার
রুমমেট আবরারকে শিবির বলে সন্দেহ হয়। আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য মিজানুর
অনুরোধ করেন। ৪ অক্টোবর শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের ১৫ ও ১৬তম ব্যাচের ফেসবুক
মেসেঞ্জারে গ্রুপে তিনি একটি পোস্ট দেন।’
মেহেদী
জবানবন্দিতে আদালতকে বলেন, ‘আমি আবরারকে চশমা সরাতে বলি। চশমা
সরালে আমি তার গালে চড় মারি। আমি চড় মারার সঙ্গে সঙ্গে মেফতাহুল ইসলাম জিয়নও
আবরারকে চড়থাপ্পড় মারেন। তারপর তিনি ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করতে
থাকেন। একই সঙ্গে অনিকও আরেকটি ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে আঘাত করতে থাকেন। রাত
১১টার সময় মাহমুদ সেতু আবরারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। অনিক সেতুর কাছে জানতে
চেয়েছিলেন, তারা কী করবেন? তখন সেতু বলেন,
কী
আর করবি, মার। তখন অনিক সরকার ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে
আবরারের পিঠে, পাঁজরে, বুকে, শরীরের
নিম্নাংশে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আঘাত করতে থাকেন। আবরার তখন চিৎকার করতে থাকেন।
বাঁচার জন্য কাকুতি–মিনতি করতে থাকেন। সে সময় ইফতি আবরারকে লাথি মারতে থাকেন। আর
মুজাহিদ স্কিপিং রোপ দিয়ে তার পায়ে আঘাত করতে থাকেন।’
মুজাহিদুর
রহমানের জবানবন্দি :
মুজাহিদুর রহমান
বুয়েটের ১৭তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র
ছিলেন। মুজাহিদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, “সেদিন ইফতি
আবরারকে দাঁড় করিয়ে কয়েকটা চড়থাপ্পড় মারেন। ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে দুই থেকে তিনটা
বাড়ি মারেন। রবিন তখন তাকে বলেন, ‘তোর ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র অথচ তুই
ফ্রেন্ড লিস্টে নাই।’ এই কথা শোনার পর তিনি খেপে রুমে পড়ে থাকা স্কিপিং রোপ দিয়ে
আবরারের হাঁটুর ওপরে কয়েকটা বাড়ি মারেন। এমন সময় ইফতি বলেন, ‘এভাবে
হবে না।’ তখন ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারকে জোরে জোরে মারতে থাকেন। এক সময় ক্রিকেট
স্টাম্পটি ভেঙে যায়। তখনও আবরার কারও নাম না বলায় অনিক নতুন আরেকটা স্টাম্প দিয়ে
মারতে থাকেন। একপর্যায়ে আবরার মাটিতে শুয়ে পড়েন। তখনও অনিক আবরারকে মারতে থাকেন।
একপর্যায়ে আবরার প্রস্রাব করে দেন। আবরার পানি চাইলে মোর্শেদ তখন পানি দিতে যান।
তখন অনিক বলেন, ‘তুই পানি দিতে গেলে তোকেও মারব।’ অনিক আবরারকে
এলোপাতাড়ি মারতে থাকেন। একপর্যায়ে আবরার নিস্তেজ হয়ে পড়েন।”
মিফতাউল ইসলাম
জিয়নের জবানবন্দি :
বুয়েটের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষে পড়তেন মিফতাউল ইসলাম জিয়ন। তিনি শেরেবাংলা হলে থাকতেন। জবানবন্দিতে মিফতাউল বলেন, ‘সেদিন রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে রবিন তাকে ফোন দিয়ে জানান, শিবিরের এক ছেলেকে আটক করা হয়েছে। তিনি যেন হলের নিচে নামেন। পরে তিনি হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে যান। ওই কক্ষে গিয়ে প্রায় ১৫ জন ছাত্রকে দেখেন। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে রবিন আবরারের গালে চড় মারতে থাকেন। তখন আবরার চুপ ছিলেন। ইফতি আবরারের ফেসবুকের কার্যক্রম দেখে ক্ষিপ্ত হন। তখন ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাতে ও পায়ে মারতে থাকেন। মুজাহিদ স্কিপিং রোপ (দড়ি) দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। মারধরের একপর্যায়ে ইফতির হাতে থাকা ক্রিকেট স্টাম্প দুই ভাগ হয়ে যায়। ওই সময় কেউ একজন আরেকটি স্টাম্প নিয়ে ওই কক্ষে আসেন। ওই স্টাম্প দিয়ে অনিক আবরারকে মারতে থাকেন। এরপর মিফতাউল আবরারকে মারধর করেন। হলে আর কে কে শিবির করে, তা জানতে চান। কিন্তু নাম না বললে তিনি ভাঙা ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে আবরারের পায়ে আঘাত করেন।’
মনিরুজ্জামান
মনিরের জবানবন্দি :
মনিরুজ্জামান
মনির পড়তেন বুয়েটের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগে। থাকতেন শেরেবাংলা হলে। তার রুমমেট
ছিলেন মেহেদী। জবানবন্দিতে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘২০১৯ সালের
অক্টোবর মাসের শুরুতে হলের ১৫ ও ১৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ফেসবুক মেসেঞ্জারে
বার্তা দিয়ে মেহেদী বলেন, আবরার শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই
তাকে হল থেকে বের করে দিতে হবে। সেদিন অনিক ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে মারধর করতে
থাকেন। তখন আবরার বমি করেন।’
এস/এম. জামান