• ঢাকা রবিবার
    ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কমলা ভট্টাচার্য : ভাষার জন্য শহীদ প্রথম নারী

প্রকাশিত: মে ২০, ২০২১, ০৮:১২ পিএম

কমলা ভট্টাচার্য : ভাষার জন্য শহীদ প্রথম নারী

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা


‘এপার-বাংলা, ওপার বাংলা মধ্যে জলধি নদী/নির্বাসিত নদীর বুকে বাংলায় গান বাঁধি/আমার বাংলা ভাসে, বেহুলা  ভেলায়/ দেশ বিভাগের শ্মশানে/ একুশে উনিশে রফিক-কমলা জ্বলে/রাজপথে ময়দানে।’ বাংলা লোকগানের জনপ্রিয় দল ‘দোহার’-এর প্রতিষ্ঠাতা, অকালপ্রয়াত লোকগানের উজ্জ্বল নক্ষত্র কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য এই গানটিতে যে কমলার কথা বলেছেন সেই কমলা ভাষার দাবিতে শহীদ হওয়া প্রথম নারী। এর আগে বিশ্বে ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে কোনো নারীকে প্রাণ দিতে হয়নি। কমলা ভট্টাচার্যই ভাষার বেদিমূলে উৎসর্গকৃত প্রথম নারী প্রাণ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে তিনি শহীদ হন। তার প্রয়াণের ষাট বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল। 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রভাত ফেরিতে নারীদের উপস্থিতি আন্দোলনকে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা। বাংলার নারীদের সেই প্রতিবাদ উজ্জীবিত করেছিল সিলেটের ঢাকা দক্ষিণে জন্ম নেয়া কমলা ভট্টাচার্যকে। ১৯৬১ সালে যখন আসামে ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলো তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। মায়ের ভাষার আন্দোলনে জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে নামলেন। প্রাণ উৎসর্গ করলেন তিনি ভাষার জন্য। 
পিতা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবীর তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন পঞ্চম। ১৯৫০ সালে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অন্য আরও অনেকের মতো জন্মস্থান ছেড়ে ওপারে যান কমলা। 

আসামের কাছাড় জেলার শিলচরে বসবাস শুরু করেন তারা। শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন তারা। কমলার মেজ দিদি প্রতিভা ছিলেন শিক্ষিকা। তার আয় দিয়ে কোনোরকমভাবে চলত সংসার।  

শৈশবে কমলা ভর্তি হন শিলচরের ছোটেলাল শেঠ ইনস্টিটিউটে। কিন্তু স্কুলের বই কেনার ক্ষমতা ছিল না তার। কমলা একবার বড়দিদি বেণুকে একটি অভিধান কিনে দিতে বললে তিনি সেটা কিনে দিতে পারেননি। কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে তার বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতেন। ১৯৬১ সালে কমলা ম্যাট্রিক পরিক্ষায় বসেন। তার ইচ্ছা ছিল পারিবারিক আর্থিক অনটন সত্ত্বেও তিনি স্নাতক পর্যন্ত পড়বেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে তিনি টাইপরাইটিং শিখে চাকরি-বাকরি করবেন। 

ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরের দিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে একটি পিকেটিংয়ের ডাক দেয়া হয়। সেদিন সকালে, অর্থাৎ ১৯ মে সকালে কমলাও পিকেটিংয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। সকালে স্নান করে মেজদিদির রাখা শাড়িটা পরে নেন কমলা।

মেজদিদি পিকেটিংয়ে যেতে বারণ করলেও শোনেন না কমলা। এমন সময় ২০-২২ জনের একটি মেয়েদের দল কমলাদের বাড়িতে আসে কমলাকে নেয়ার জন্য। কমলার মা উদ্বেগ প্রকাশ করলে তারা কমলার মাকে বুঝিয়ে রাজি করেন। কমলার মা কমলাকে এক টুকরো কাপড় দেন কাঁদানে গ্যাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কমলার সাথে বেরিয়ে পড়ে কমলার ছোট বোন মঙ্গলা, ছোট ভাই বকুল ও তার বড় বোনের ছেলে বাপ্পা।
দুপুরবেলা কমলার মা দুশ্চিন্তা করতে করতে নিজেই গিয়ে উপস্থিত হন রেল স্টেশনে। বকুল ও বাপ্পাকে পুলিশ আটক করলেও কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। মাকে দেখতে পেয়েই ছুটে আসেন কমলা। মায়ের ধূলিধূসরিত পা ধুয়ে দিয়ে, শরবত খেতে দেন। মায়ের সমস্ত দুশ্চিন্তা নিবারণ করে মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই সমাধা হয়। যদিও অবস্থানের সময়সূচি ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। কিন্তু শেষ ট্রেনটি ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ। এরপর গণ-অবস্থান স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই আসাম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে  ফেলতে শুরু করে। বেলা ২টা ৩৫ মিনিট নাগাদ আকস্মিক তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটাতে শুরু করে। এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জে অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিগ্বিদিক যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোট বোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, সাহায্যের জন্য কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। অন্যদিকে আসাম রাইফেলসের সদস্যরা পলায়নরত আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে আসেন। এ সময় একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে মাথা চুরমার করে দেয়। আহত ও গুলিবিদ্ধ অন্যদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কমলা। তিনিসহ ১১ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়, আসামে মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার।

অপূর্ব শর্মা : ২০ মে

জাতীয় সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ