প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২১, ০২:৫২ পিএম
কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতরে আততায়ীদের গুলিতে রোহিঙ্গা
নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হওয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ
করছে। যেকোনো সময়ে এসব ক্যাম্পে আবার সহিংসতা ঘটতে পারে বলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের
অনেকে আশঙ্কা করছেন।
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গার স্রোত নামার পর গত চার
বছরে এরকম আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আর কখনও তৈরি হয়নি। হামলার ভয়ে রোহিঙ্গাদের অনেক
নেতা ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ করতে চাননি এরকম একজন শরণার্থী বলেছেন,
বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাতে মুহিবুল্লাহকে কয়েকজন বন্দুকধারী গুলি করে
হত্যা করে। হত্যাকারীদের পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ এখনও কিছু ধারণা করতে পারেনি।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চার বছর পর মংডুর
সাবেক এই স্কুলশিক্ষক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াসহ তাদের অধিকার
প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছিলেন। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান
রাইটস নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি 'মাস্টার মুহিবুল্লাহ' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্রের
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং কয়েক বছর আগে ক্যাম্পের
একটি ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার উপস্থিতে এক সমাবেশ আয়োজন করার পরেই
রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে তার নামটি সামনে চলে আসে। রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি বেশ
জনপ্রিয়ও ছিলেন।
বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের একজন বলছেন
মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নাজুক পরিস্থিতি আবারও
স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, "ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং চরমপন্থি সশস্ত্র গ্রুপ
ক্রিয়াশীল। যেমন আরসা, আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামি মাহাত। এর
পাশাপাশি সিভিল রাইটস ও মানবাধিকার ইস্যুতেও আন্দোলন করছে কিছু সংগঠন। তার মধ্যে
অন্যতম হচ্ছে মুহিবুল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান
রাইটস।"
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, মুহিবুল্লাহর
মতাদর্শের বিরোধীরা তাকে হত্যা করে থাকতে পারে। মুহিবু্ল্লাহর ভাই হাবিবুল্লাহও এই
হত্যাকাণ্ডের জন্য আরসা নামের একটি সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছেন।
‘৯০-এর দশকের শুরুতে রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে পালিয়ে আসে তখন থেকেই
ক্যাম্পগুলোতে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি বা আরসা নামের একটি সংগঠন সক্রিয়
রয়েছে। এই গ্রুপের নেতারা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের অধিকার
প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছেন।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি এই আরসা
গ্রুপটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আরসার নেতাদের সমর্থনে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে আরও একটি
চরমপন্থি সংগঠন- আল ইয়াকিন। অনেকে এটিকে আরসার "ছায়া সংগঠন" বলেও
উল্লেখ করেছেন।
কক্সবাজারের সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ বলেন, "এই সংগঠনটি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ঘোরবিরোধী। তাদের নেতারা কখনও
মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান না। কারণ বর্মী সেনাবাহিনী তাদের খুঁজছে। গেলে তাদের
দণ্ড ভোগ করতে হবে। এজন্য তারা চায় না যে রোহিঙ্গারা কখনও তাদের দেশে ফিরে যাক।
তাদের কথা হলো : তাদেরকেও যেতে দেব না, আমরাও যাব না।
সে কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে যেসব সংগঠন কাজ করছে সেগুলোর সঙ্গে তাদের
একটা বিরোধ রয়েছে এবং এজন্য তাদের নেতাদের টার্গেট করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ার
পর প্রত্যাবাসনের পক্ষে যেসব রোহিঙ্গা নেতা কাজ করছেন তাদের অনেকে আত্মগোপনে চলে
গেছেন।
রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার বিরুদ্ধে ইসলামি মাহাত নামের আরও একটি সংগঠনও
শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে তৎপর রয়েছে। এদের কার্যক্রম সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অল্প
কয়েকটি ক্যাম্পে শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও যেসব সংগঠন কাজ করে তাদের মধ্যে
রয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়ন বা এআরএনইউ, ভয়েস অফ রোহিঙ্গা। মানবাধিকার কর্মী নূর খান
লিটন বলেন, "সম্প্রতি দেখা
গেছে মুহিবুল্লাহর সংগঠনটি পুরো কমিউনিটিতে একচ্ছত্র সমর্থন আদায় করতে সক্ষম
হয়েছে। এরা সবসময় শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করেছে। গণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়গুলোর সমাধান চেয়েছে যা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর
অবস্থানের বিরুদ্ধে।"
তিনি বলেন, "মুহিবুল্লাহকে
হত্যার ফলে রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন, গণহত্যার বিচার করার যে দাবি, তাদের ফিরে যাওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা সেসব কিছুটা
হলেও হোঁচট খাবে এবং সশস্ত্র ও চরমপন্থি সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রক
ভূমিকায় চলে আসতে পারে।"
কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা
ক্যাম্পগুলোতে চরমপন্থি কোনো সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। উখিয়ায় রোহিঙ্গা
ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাইমুল হক। তিনি বলেন, "আরবিতে যেটাকে আল ইয়াকিন বলা হয়, মিয়ানমারের ভাষায় সেটাকেই বলা হয় আরসা।
আমাদের এখানে এই গ্রুপের অস্তিত্ব নেই। এখানে কিছু দুষ্ট রোহিঙ্গা আছে, এরা সন্ত্রাসী প্রকৃতির, তারা এই নামটা ব্যবহার করে, নিজেদের এই নামে পরিচয় দেয়।"
তিনি বলেন, আরএসও-সহ আরও যেসব সংগঠন
এখানে রয়েছে সেগুলো অনলাইন-ভিত্তিক। তাদের তেমন একটা কর্মকাণ্ড নেই। রোহিঙ্গাদের
মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পক্ষে তারা অনলাইনে লেখালেখি করে। ইসলামি মাহাত বলে কোনো সংগঠন আছে কিনা সেটা আমরা জানি না। এই প্রথম আপনার কাছে শুনলাম। আমরা হয়তো এটা
নিয়ে স্টাডি করব যে এরকম কিছু আছে কিনা।
পরিবারটি প্রথম দফায় ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর অপহরণকারীরা যে নম্বর থেকে ফোন
করেছিলেন সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এর পর পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ
করা সম্ভব হয়নি এবং মাহমুদুল করিমের অবস্থান সম্পর্কেও তারা কিছু জানতে পারেনি।
কিন্তু অপহরণের এক মাস পর ৩২ বছর বয়সী মাহমুদুল করিমের যখন খোঁজ পাওয়া যায় তখন
তিনি আর জীবিত নেই।
মাহমুদুল করিমের প্রতিবেশী এবং এনজিও কর্মী রিয়াজুল হাসান জানান, বনবিভাগের শ্রমিকরা আগস্ট মাসে নতুন গাছ
লাগানোর জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করতে গেলে সেখানে একটি কঙ্কাল দেখতে পান। সেই
কঙ্কালের পরনের পোশাক দেখে তাকে মাহমুদুল করিম হিসেবে চিহ্নিত করে তার পরিবার।
অপহরণকারী দলের একজন সদস্য পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। তিনি পুলিশকে
জানিয়েছেন যে, মাহমুদুল করিমকে তারা
হত্যা করেননি। তাদের চেয়েও শক্তিশালী আরেকটি দল করিমকে তাদের কাছ থেকে ছিনতাই করে
নিয়ে যায়। তিনি দাবি করেন সম্ভবত তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, অল্প একটু
জায়গায় প্রচুর মানুষ বসবাসের কারণে এসব ক্যাম্পে ঝগড়া-বিবাদ সংঘাত লেগেই থাকে।
পুলিশ বলছে, অপহরণকারীদের এই দলটি
রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা
ক্যাম্পগুলোতে এরকম কতগুলো গ্রুপ সক্রিয় তার কোনো হিসেব নেই। তবে পুলিশ, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক ও
স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা করা যায় যে, এ ধরনের কুড়িটির মতো গ্রুপ
কক্সবাজারে সক্রিয় রয়েছে।
স্থানীয়ভাবে এসব গ্রুপ 'অপহরণ
বাহিনী" নামে পরিচিত। টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী
ও স্থানীয় লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করাই তাদের কাজ। ক্যাম্পে আধিপত্য
বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য এসব গ্রুপের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের ঘটনা
ঘটে থাকে। তাদের মধ্যে গোলাগুলিতে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছে।
স্থানীয়দের মধ্যে এসব গ্রুপের নেতাদের নামেই বাহিনীগুলোর পরিচয় গড়ে উঠেছে।
যেমন: রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন বাহিনী
ইত্যাদি। এসব বাহিনীর কয়েকশ করে সদস্য, স্থানীয় লোকজনের
কাছে যারা ডাকাত হিসেবে পরিচিত।
কক্সবাজারের সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০১৭ সালে লাখ
লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার চার বছর পর ক্যাম্পগুলোতে এদের অপরাধমূলক তৎপরতা
বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে দিনের বেলায় থাকে সরকারি বাহিনী। রাতের
বেলায় সশস্ত্র বাহিনী। সন্ধ্যা নেমে যাওয়ার পর সেখানে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু থাকে
না। সন্ত্রাসীরা যেভাবে চায় সেভাবেই চলে।
রাতের বেলায় এরা ক্যাম্পে নেমে এলেও সকাল হওয়ার আগেই তারা টেকনাফের পাহাড়ি
জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানেই তারা বসবাস করেন।
সাংবাদিকরা বলছেন, অপহরণের পাশাপাশি এসব গ্রুপ ইয়াবা ও আইসের মতো মাদক ও অস্ত্রপাচার এবং ব্যবসা, চোরাচালান ও রোহিঙ্গা নারীদের দিয়ে যৌন ব্যবসার করানোর সঙ্গে জড়িত।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, বলেন, "এক কথায় ক্যাম্পগুলোর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
ভালো না। পারিবারিক সংঘাত আছে, মাদক পাচারকারী ও
অস্ত্র ব্যবসায়ীরা ক্যাম্পগুলোকে ব্যবহার করছে। অল্প জায়গায় প্রচুর সংখ্যক
মানুষ বসবাস করার কারণে নানান ধরনের ঝগড়া-বিবাদ সংঘাত লেগেই থাকে। তরুণ ছেলেপেলের
লেখাপড়ার করার তেমন সুযোগ নেই, খেলাধুলা নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই।, এ কারণে তারা খুব সহজেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের
দিকে ঝুঁকে পড়ছে।"
উখিয়ার ক্যাম্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাইমুল হক বলেন, এধরনের বাহিনীর তৎপরতা উখিয়াতে নেই, টেকনাফ এলাকায় আছে। উখিয়াতে ততটা পাহাড়
পর্বত নেই। কিন্তু টেকনাফে অনেক বড় বড় পাহাড় আছে। ডাকাতরা ওখানে আশ্রয় নেন।
এ কারণে ওদেরকে নিয়ে আমরা মাঝে-মাঝে সমস্যায় পড়ে যাই। কারণ পুলিশের সদস্যরা সেখানে
যেতে পারেন না।"
শামীম/ডাকুয়া