প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১, ১২:০৫ পিএম
ঢাকার একটি কলেজের ছাত্রী ছিল কুমিল্লার মেয়ে মোসারাত জাহান মুনিয়া। গত ২৬
এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার একটি ফ্ল্যাট থেকে তার
লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সামনে আসে বসুন্ধরা
গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের নাম। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে রাতেই
তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া।
সেই মামলায় সায়েম সোবহান আনভীরের সংশ্লিষ্টতা পায়নি পুলিশ। যার কারণে
আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে ১৯ জুলাই আদালতে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে
গুলশান থানা পুলিশ। কিন্তু ২২ জুলাই ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার সুদীপ
কুমার চক্রবর্তী গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হয়।
এরপর সেই প্রতিবেদনের ব্যাপারে আদালতে নারাজি দেবেন বলে জানিয়েছিলেন মামলার
বাদী মুনিয়ার বোন নুসরাত। তিনি বলেন, ‘এটাতো অন্যায়। আমি আদালতে নারাজি দেব। মাঝখানে বেশ কিছুদিন পার হয়ে যায়।
আবারও আলোচনায় আসে মুনিয়ার ঘটনা।’
থানা ছেড়ে সরাসরি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত। সোমবার
(৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮-এর বিচারক মাফরোজা
পারভীনের আদালতে মামলা করেন তিনি। মামলায় ছোট বোন মুনিয়ার মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায়
আটজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
তার হলেন—বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর,
আনভীরের মা আফরোজা,
আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা,
আনভীরের বাবা আহমেদ আকবর
সোবহান, শারমিন, সাফিয়া রহমান মিম, মডেল পিয়াসা ও ইব্রাহীম আহমেদ রিপনকে। পিয়াসা
বর্তমানে পুলিশের করা অপর এক মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বিশেষ পিপি রেজাউল করিম জানান, আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে মামলাটির
বিষয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার এজাহারে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে-
অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন মুনিয়া :
বড় বোন নুসরাত মামলায় অভিযোগ করেছেন, মুনিয়ার মৃত্যুর পর যে ময়না তদন্ত করা হয়েছে; সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ভিকটিম ২/৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।’
মামলার আর্জিতে আরও বলা হয়, ‘মুনিয়া প্রতিদিন
ডায়েরি লিখতেন। বাসায় তার লেখা চারটি ডায়েরি পাওয়া গেছে। যাতে আসামি আনভীরের সঙ্গে
মেলামেশা ও শারীরিক সম্পর্কের কথা তারিখ দিয়ে লেখা রয়েছে। একটি ডায়েরির কাভারে
লেখা ছিল … ‘Anvir I love you’.
এজাহারে দাবি করা হয়, “ভিকটিম ২/৩ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে ভিকটিম ১ নম্বর আসামিকে বিয়ের জন্য চাপ দেন। এতে উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও চরম বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিষয়টি অপর আসামিদের মধ্যে প্রকাশ পেলে তারা পারিবারিক সুনাম-সুখ্যাতি রক্ষায় ভিকটিমকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে ১ নম্বর আসামি ভিকটিমকে বলে, ‘তুমি কুমিল্লা চলে যাও। মা তোমাকে মেরে ফেলবে’। এ সময় ভিকটিম মুনিয়া লাইভে এসে সব ঘটনা ফাঁস করে দেবে বলে ১ নম্বর আসামিকে হুমকি দেয়। পাল্টা জবাবে আসামি ভিকটিমকে বলে, ‘এত সময় আর তুই পাবি না’।”
ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে মুনিয়াকে :
অভিযোগের ১৪তম অংশে বলা হয়, ‘অত্র মামলার
আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে ঘটনার তারিখ ভিকটিমকে বাসা থেকে পালানোর সুযোগ না
দিয়ে বাসায় আটকে রেখে কিলিং মিশনের মাধ্যমে ভিকটিমকে ধর্ষণোত্তর হত্যাকাণ্ড
সংঘটিত করে সুকৌশলে ঘটনাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য ভিকটিমের লাশ
ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে।’ ১৬তম অংশে লেখা ‘তদন্ত
রিপোর্টে ভিকটিমের সঙ্গে মৃত্যুর পূর্বে Intercourse-এর প্রমাণ মিলেছে, অর্থাৎ ভিকটিম মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষিত।’
পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ :
১৭তম অংশে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিষয়ে বলা হয়, ‘পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ভিকটিমের হাতের লেখা
ডায়েরি, মোবাইলসহ
অন্যান্য মালামাল জব্দ করলেও রুমে পাওয়া রক্তমাখা জামা জব্দ করেনি।’ পরবর্তী ১৮তম
অংশে বলা হয়, ‘বাদী থানায়
মামলা করতে গেলে কর্তৃপক্ষ বাদীর অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১)
(২)/৩০ ধারা এবং ৩০২/৩৪ ধারা উপাদান থাকা সত্ত্বেও উক্ত ধারায় মামলা রেকর্ড করতে
অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।’
মুনিয়া ঢাকা থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন :
মুনিয়া ঢাকা থেকে পালাতে চেয়েছিলেন দাবি করে অভিযোগের চতুর্থ অংশে লেখা হয়,
‘ভিকটিম ঘটনা আঁচ করতে
পেরে আসামিদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাকা ছেড়ে যশোর পালিয়ে যেতে চায়
এবং এজন্য শেষ ঘটনার তারিখ ভোর ৫টায় এবং সকাল ৭টায় ৫/৮ নম্বর আসামি বাড়িওয়ালার
নিকট গাড়ি চায়। ৫/৮ নম্বর আসামি গাড়ি না দিয়ে উল্টো বিষয়টি অপর আসামিদের নিকট
ফাঁস করে দেয়। তখনই সকল আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ভিকটিমকে বাসায় আটকে রেখে
হত্যার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে এবং কিলিং মিশন দিয়ে ভিকটিমকে ধর্ষণোত্তর হত্যা
করে আসামিরা তাদের Common intention পূরণ করে।’
বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করেছিল মুনিয়া :
২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে মুনিয়া তার বড় বোন ও মামলার বাদী নুসরাতকে ফোন
দিয়েছিল। মুনিয়া ফোনে নুসরাতকে বলে, ‘আপু আমার বিপদ, আনভীর আমাকে
ধোঁকা দিয়েছে। সে আমাকে বিয়ে করবে না। ভোগ করেছে মাত্র। তুমি তাড়াতাড়ি আসো,
আমার বড় দুর্ঘটনা হয়ে
যেতে পারে।’ আরও বলে, ‘আসার সময় ইফতারের
জন্য কলা নিয়ে এসো।’
বাড়িওয়ালা শারমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ :
অভিযোগের ষষ্ঠ অংশের বিবরণে বলা হয়, ‘ভিকটিমের হত্যার তারিখ ২৬/০৪/২০২১ইং দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে ৫ নম্বর আসামি
শারমিন বাদীকে ফোন করে বলে ‘তোমার বোনের কিছু হলে আমরা জানি না, তখন পুলিশ আসবে; মিডিয়া আসবে ইত্যাদি।’ অথচ পোস্টমর্টেম
রিপোর্ট মতে, ভিকটিমের মৃত্যু
হয় দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে। এ ঘটনা প্রমাণ করে বাড়িওয়ালা (৫ নম্বর আসামি) মৃত্যু
সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত ছিল এবং এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত।’
বাদী ঘটনার তারিখ বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে কুমিল্লা থেকে ভিকটিমের দরজা বন্ধ দেখে
অনেক পিড়াপিড়ির পরও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ৫/৮ নম্বর আসামি
বাড়িওয়ালার কাছে থাকা বাসার সংরক্ষিত চাবি চাইলে তারা ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসেবে
চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চাবি না দিয়ে তালা ভেঙে বাসায় ঢোকার পরামর্শ দেয়।’
মুনিয়ার পরনের জামাকাপড় ছেঁড়া ছিল :
অভিযোগের নবম অংশে বলা হয়, ‘পুলিশ ভিকটিমের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। এতে ভিকটিমের যৌনাঙ্গে জখম ও রক্ত পরিলক্ষিত হয়। ভিকটিমের পরিধেয় বস্ত্র, অন্তর্বাস, পাজামা, কাটা-ছেঁড়া ছিল। যাতে প্রতীয়মান হয়, হত্যার পূর্বে ভিকটিমের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়েছিল এবং ভিকটিম ধর্ষিতা হয়েছিল।’
মুনিয়া মিরপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী
ছিল। তার বাবা মৃত শফিকুর রহমান। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা সদরের দক্ষিণ পাড়া উজির
দিঘি এলাকায়।
টিআর/সবুজ/এএমকে