
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২১, ০৩:৩২ পিএম
দায়িত্বে ছিলেন অবিচল। ছিল বুকভরা সাহস আর অসীম ধৈর্য। জীবন বিপন্ন জেনেও
বিন্দু পরিমাণ টলেননি নিজ দায়িত্ব থেকে। দুই দফায় বাঁচিয়েছেন তিন শতাধিক যাত্রীর প্রাণ।
বাঙালির স্মৃতিপটে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম। যার এই বীরত্বগাথা উত্তরসূরিদের
অনুকরণীয় হবে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এই বীরের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। স্যালুট,
ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাউয়ুম।
বাংলাদেশ
এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন ক্যাপ্টেন নওশাদ। ছিলেন সহকর্মীদের
মধ্যমণি। সবার ভালোবাসায় শিক্ত ছিলেন এই বৈমানিক। তাই তো বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর)
সকালে অশ্রুসজল নয়নে এই বীরের নিথর দেহ গ্রহণ করতে দেখা গেছে সহকর্মী পাইলটদের। কান্নায়ও
ভেঙে পড়তে দেখা গেছে অনেককেই।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে বিমানের একটি ফ্লাইট তার মরদেহ নিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এ সময় বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন এলাকায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তার সহকর্মী পাইলটরা। উড়োজাহাজ সামনে আসতেই মাথার ক্যাপ খুলে শ্রদ্ধা জানান তারা।
এরপর
উড়োজাহাজ থেকে নামানো হয় ক্যাপ্টেন নওশাদের নিথর দেহ। কফিনটি কাঁধে তুলে নেন সহকর্মী
পাইলটরা। নিয়ে আসেন অস্থায়ী মঞ্চে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বেসামরিক বিমান চলাচল ও
পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন
সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন।
এরপর
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পক্ষে ফুল দেন সংস্থার চেয়ারম্যান এয়ারভাইস
মার্শাল মো. মফিদুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল, বিমানের পরিচালক জিয়াউদ্দিন
আহমেদ, মো. মাহবুব জাহান খানসহ বিমানের কর্মকর্তারাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এরপর
পাইলটরা নওশাদের মরদেহের সামনে আসেন। মাথার ক্যাপ খুলে, স্যালুট দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা
জানান। তাদের অনেককেই চোখ মুছতে দেখা যায়। সবশেষে পাইলট নওশাদকে বহনকারী কফিনটি একটি
ফ্রিজিং ভ্যানে তোলা হয়। এরপর ভ্যানটি তার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সেখানে গোসল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ নেওয়া হয় বিমানের প্রধান কার্যালয় বলাকা ভবনে। সেখানে নামাজে জানাজায় অংশ নেন ক্যাপ্টেন নওশাদের দীর্ঘদিনের সহকর্মী থেকে শুরু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এরপর
সেখান থেকে ক্যাপ্টেন নওশাদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে মায়ের কবরের
পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় বাংলাদেশ বিমানের অকুতোভয় সাহসী এই বীরকে।
বিমান
বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দোহা থেকে আসা একটি ফ্লাইট দেশে ফেরার পথে ভারতের নাগপুর থেকে
ক্যাপ্টেন নওশাদের মরদেহ নিয়ে এসেছে। একই ফ্লাইটে তার বোন দেশে এসেছেন।
ক্যাপ্টেন
নওশাদের স্ত্রী ও দুই সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। করোনাভাইরাস ও ভিসা জটিলতার
কারণে তারা দেশে আসতে পারেননি। তাই প্রিয়তমা স্ত্রী ও পাণপ্রিয় সন্তানদের শেষ দেখা
ও শেষ ছোঁয়াটুকুর অপূর্ণতা নিয়েই চলে যেতে হলো ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুমকে। বিদায়
ক্যাপ্টেন, স্যালুট তোমাকে।
গত ২৭ আগস্ট ওমানের রাজধানী মাসকাট থেকে ১২৪ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে ভারতের রায়পুরের আকাশে থাকাকালে আচমকা হার্ট অ্যাটাক করেন ক্যাপ্টেন নওশাদ আতাউল কাইয়ুম। তখনই ককপিটের কন্ট্রোল নেন সঙ্গে থাকা ফার্স্ট অফিসার মোস্তাকিম। মেডিকেল ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেন।
কলকাতার
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বিমানটিকে নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করার সিগন্যাল দিলে ফার্স্ট
অফিসারই বিমানটিকে অবতরণ করান। বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের বিমানটিতে ১২৪ যাত্রী ছিলেন। তারা
সবাই নিরাপদেই ছিলেন। নাগপুরের একটি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন নওশাদ। চিকিৎসাধীন
অবস্থায় ৩০ আগস্ট মারা যান নওশাদ।
নওশাদ
আতাউল কাইয়ুম ১৯৭৭ সালের ১৭ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে পাইলট হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ২০০০ সালের ১৩ নভেম্বর
ক্যাডেট পাইলট হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কাজে যোগদান করেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে
২০০২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এফ-২৮এর ফার্স্ট অফিসার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ২০০৬
সালের ১৪ মে এয়ারবাস-এ-৩১০ উড়োজাহাজের ফার্স্ট অফিসার এবং ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বোয়িং
৭৭৭-এর ফার্স্ট অফিসার হন। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বোয়িং ৭৩৭-এর ক্যাপ্টেন
হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং মৃত্যুর পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত তিনি এ পদেই কর্মরত ছিলেন।
তার বাবা আব্দুল কাইয়ুমও এক সময় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্যাপ্টেন ছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় ‘কোরিয়ান এয়ার’ এবং ‘সৌদি এয়ারলাইন্সেও’ দায়িত্ব পালন করেন সিনিয়র এই পাইলট। ছয় মাস আগে নওশাদের বাবা আব্দুল কাইয়ুম মারা যান।
বেসামরিক
বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী মোহাম্মদ মাহবুব আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘পাইলট নওশাদের
অকালমৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। উনার মৃত্যু আমাদের বিমান পরিবারের জন্য অপূরণীয়
ক্ষতি। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় উনার মৃত্যু একটা ভিন্নমাত্রা বহন করে।’
তিনি
বলেন, ‘যে মুহূর্তে এই ঘটনা ঘটে, তখন বাপা ও বিমানের এমডির সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তার
উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছিলাম। পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় উন্নত
চিকিৎসার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু পাইলট নওশাদ শুরুতেই সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলেন।
তিনি কোমায় ও লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো ধরনের ত্রুটি করা হয়নি।’
সবুজ/এম.
জামান