আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে হজম করতে পারা পাখির নাম শকুন। এ ছাড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টির অধিকারী শিকারি পাখিটিও বটে। পাখিগুলোর গলা, ঘাড় ও মাথায় থাকে না কোনো পালক। প্রশস্ত ডানায় ভর করে ওড়ে নীল আকাশে। তবে মানুষের পছন্দের তালিকায় এই পাখিটির নাম খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু নীরবে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখছে শকুন। তা বোঝার উপায় নেই। আর এর জন্যই পাখিগুলোর উপযোগিতা ভালোভাবেই স্বীকৃত। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছিল শকুন। হঠাৎ করে কেন এই শকুনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাচ্ছিল, সেটা কেউ বুঝতে পারছিল না।
তখনকার তরুণ রিসার্চ বায়োলজিস্ট মুনির ভিরানি শকুন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ দেখান। কাজ পান পেরিগ্রিন ফান্ড বলে একটি প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে সেই প্রতিষ্ঠানটিরই নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিকারি পাখি সংরক্ষণ প্রকল্প চালায় এই প্রতিষ্ঠান।
মুনির ভিরানি বলছিলেন, ‘তখন এই শকুনের সংখ্যা যে হারে কমছিল, তা আসলেই ভয়াবহ। পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছিল; আকাশের দিকে তাকালে কোথাও শকুন দেখা যায়নি।’
উপদ্রব না উপকারী?
প্রায় ২৬ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে শকুনের বাস। শকুন মৃত পশুর দেহ দ্রুত সাবাড় করে। তাদের পাকস্থলীর ধারণ ক্ষমতা অসাধারণ। মৃত পশুর দেহ তো বটেই, তাদের হাড় পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে শকুন। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে শকুনের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, ভারত বা পাকিস্তানের মতো দেশে শকুনকে একটা উপদ্রব বলে গণ্য করা হতো, এগুলোকে যে সংরক্ষণ করা দরকার, সেটার কথা কারও মাথাতেই ছিল না।
ধারণা করা হয়, ৭০-এর দশকের শুরুর দিকে ভারতের জয়পুর-আগ্রা এবং দিল্লির মধ্যবর্তী অঞ্চলেই কেবল ৪ কোটি শকুন ছিল এরকম। এর প্রধান কারণ ভারতের হিন্দুরা গরুকে পবিত্র বলে মনে করে এবং এর মাংস খায় না। কাজেই গরু আপনা আপনি মারা গেলে তা খেতো শকুন।
এ বিষয়ে মুনির ভিরানি বলেন, ‘যখন গরু মারা যায়, তখন এগুলোর মৃতদেহ কোথাও ফেলে আসতে হয়। সেখান থেকে পরিবেশ দূষণ হতে পারত। কিন্তু শকুন মরা গরু খাওয়ায় কাঠ জ্বালিয়ে গরুর দেহ পোড়াতে হচ্ছে না। আর এতে কোনো কার্বন দূষণ ঘটাছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনি একটি প্রাণীর দেহ দান করছেন আরেকটি প্রাণীকে। সেই প্রাণী আপনার সব কাজ করে দিচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই সেবা আপনি পাচ্ছেন একেবারে বিনামূল্যে।’
শকুন উধাও :
সবকিছু নিয়মিতই চলছিল। কিন্তু ভারতীয় শকুন বিশেষজ্ঞ ড. ভিবু প্রকাশ ১৯৯৬ সালে দেশটির একটি ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে খুব কম শকুনই দেখতে পেলেন। অনেক শকুন মরে পড়ে ছিল। তারপর তিনি আশে-পাশের গ্রামে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাকে জানালেন, পুরো অঞ্চল থেকে শকুন উধাও হয়ে যাচ্ছে। মুনির ভিরানি যখন ২০০০ সালে ভারত সফরে গেলেন, তখন পরিস্থিতি আরও গুরুতর। ততদিনে শকুন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় শকুন বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে বলে একটা আশঙ্কা তৈরি হলো। মুনির ভিরানি এবং পেরেগ্রিন ফান্ডে তার অন্য সহকর্মীরা তখন এর কারণ খোঁজার চেষ্টা শুরু করলেন। তখন শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য অদ্ভুত সব কারণের কথা বলা হচ্ছিল।
শকুন মরার রহস্যভেদ :
এরপর এই গবেষক দল শকুন মারা যাওয়ার একটা অভিন্ন সূত্র খুঁজে পেলেন। মুনির ভিরানি বলেন, ‘এসব পাখি আসলে মারা যাচ্ছিল কিডনি বিকল হয়ে। আমরা যখন এই শকুনের দেহ ব্যবচ্ছেদ করলাম, তখন দেখলাম, তাদের পাকস্থলী, ফুসফুস, কিডনি, লিভার—এগুলো চকের মতো সাদা আঠালো পিণ্ডে আবৃত। এটি আসলে ইউরিক এসিড। যার কারণে পাখির কিডনি বিকল হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখলাম ইউরিক এসিড আসছে ডাইক্লোফেনাক থেকে। ডাইক্লোফেনাক খুব কার্যকর একটি ব্যথানাশক। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে এটি পেটেন্ট করা হয়। এটি ছিল খুবই সস্তা। দোকানে গিয়েই কেনা যেত। এক বোতল ওষুধ মাত্র দশ সেন্টে পাওয়া যেত। এটা গবাদিপশুর ওপর নির্বিচারে ব্যবহার করা হতো।
মুনির ভিরানি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় গবাদিপশু দিয়ে লাঙল টানা হয়, ক্ষেতের ফসল বাজারে নেয়া হয়। কোনো গবাদিপশু যখন একটু খোঁড়াতে থাকে, তখন তার শরীরে এই ডাইক্লোফেনাক ইনজেকশন দেয়া হয়। যার কারণে সেই মরা গরুর মাংস খেয়ে শকুনও মারা যেত। এভাবেই বিলুপ্ত হতে যাচ্ছিল শকুন।
শকুন রক্ষার আন্দোলন :
কাজেই মুনির এবং তার গবেষক দল অন্যান্য সংরক্ষণবাদীদের সঙ্গে মিলে শকুন রক্ষার আন্দোলন শুরু করলেন। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ডাইক্লোফেনাকের বিরাট মজুত ছিল। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এটার ব্যবহার এরপরও অব্যাহত ছিল। তবে তারপর আস্তে আস্তে অবস্থার উন্নতি হয়।
মুনির ভিরানি বলেন, সে সময় থেকে আমরা ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানে শকুনের সংখ্যার ওপর নজর রাখছিলাম। আমাদের জরিপে দেখা যায়, এরপর শকুনের সংখ্যা স্থিতিশীল হতে শুরু করে, এবং কিছু কিছু জায়গায় তাদের সংখ্যা বাড়তেও শুরু করে। তবে এরকম একটা আশঙ্কা আছে যে নতুন কোনো ওষুধ হয়তো আবার শকুনের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তিনি আরও বলেন, শকুন এখনো বিপদমুক্ত নয়। কারণ বাজারে নতুন নতুন ওষুধ আসছে। যেগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার, এগুলো শকুনের কোনো ক্ষতি করে কিনা। তাই এই লড়াইটা অনেক দীর্ঘ।
দক্ষিণ এশিয়ায় শকুনের সংখ্যা যেভাবে কমে গিয়েছিল, অন্য কোনো প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা এত দ্রুত কমে যাওয়ার নজির আর নেই। তবে শকুন যে কত উপকারী এক প্রাণী, এই সংকট তা মানুষকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
টিআর/এএমকে
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন