• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১
গাজায় নির্মম হত্যা

কবে থামবে ইসরাইল কোথায় গিয়ে থামবে?

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ০১:০৭ এএম

কবে থামবে ইসরাইল কোথায় গিয়ে থামবে?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে এক চিলতে ভূখণ্ড গাজা। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। চারদিক উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত এই উপত্যকাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কারাগার বলা হয়ে থাকে। বছরের পর বছর ধরে চলমান নির্যাতন-নিপীড়নের জবাবে গত বছর ৭ অক্টোবর অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ড থেকে ইসরাইলের ভেতর আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস।

ওই হামলার অজুহাতে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় শুরু হয় ইসরাইলের বর্বর সামরিক আগ্রাসন যা গত ১৩ মাসের বেশি সময় ধরে চলছে। আর এতে ইসরাইলকে গোলাবারুদ সরবরাহ থেকে শুরু করে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো পশ্চিমা বিশ্ব।

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বললেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা আর সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। মূলত নিরীহ ও নিরস্ত্র গাজাবাসী ও এবং তাদের ঘরবাড়ি, আশ্রয়শিবির ও স্কুল-কলেজ তথা বেসামরিক অবকাঠামোকেই লক্ষ্যবস্তু করতে দেখা গেছে। হাজার হাজার টন বোমা ফেলা হয়েছে। এতে শত শত হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।

স্যাটেলাইটে তোলা আগের ও পরের ছবিতে গাজায় বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, তাতে প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দার নগর গাজা এক বছর আগে যেমন ছিল, তার সঙ্গে এখনকার গাজার খুব সামান্যই মিল পাওয়া যায়।

ইসরাইলের হামলায় গাজার জনবসতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মুছে ফেলা হয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন মসজিদ ও গির্জা। ধ্বংস করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজমি। মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের (১৪১ বর্গমাইল) ছোট্ট ভূখণ্ডটিতে ধ্বংসের মাত্রা এতটাই তীব্র যে অনেক বাসিন্দা নিজেদের বাড়িতে এখনই ফিরতে পারবেন না এবং সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতেও সক্ষম হবেন না।

জাতিসংঘের দুই অঙ্গ সংগঠন ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) ও ইউএন ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর ওয়েস্টার্ন এশিয়ার (ইউএনইএসসিডব্লিউএ) এক যৌথ মূল্যায়ন প্রতিবেদন মতে, গাজার প্রায় ৬০ শতাংশ ভবন এবং ৫৭ শতাংশ কৃষি জমি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।

সরকারিভাবে তথা ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, হতাহতের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। এরমধ্যে নিহত প্রায় ৪৫ হাজার। আহত ১ লাখ ৫ হাজার ৭৩৯ জন। যার ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। এছাড়া উপত্যকাজুড়ে ধ্বংস হওয়া বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও ১৩ হাজারেরও বেশি নিখোঁজ রয়েছেন। ধরে নেয়া যায়, তারাও মারা গেছেন। একইভাবে হত্যাযজ্ঞ চলছে অধিকৃত পশ্চিম তীরেও।

ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার সময় গাজার জনসংখ্যা ছিল ২৩ লাখের মতো। যার বেশিরভাগই শরণার্থী এবং তারা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাস করতেন। ইসরাইলি আগ্রাসনে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হওয়ায় প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা এখন উদ্বাস্তু। খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ প্রান্তরই এখন তাদের ঠিকানা।

সেই খোলা প্রান্তরেই খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে কোনো রকমে দিন গুজরান করছেন গাজাবাসী। কিন্তু এখানেও চলছে অবিরাম নির্বিচার বোমাবর্ষণ। হামাস নির্মূল করার কথা বললেও সাধারণ ফিলিস্তিনিদেরকেই নির্মূল করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও গণহত্যার অভিযোগ রুজু হয়েছে।

এরপরও ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ থামানোর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, গাজায় কী চায় জায়নবাদী ইসরাইল? কী তাদের পরিকল্পনা ও কোথায় থামবে তারা? আলোচ্য অংশে সেসব প্রশ্নেরই জবাব খোঁজার চেষ্টা থাকবে।

 ইতিহাসের পরিক্রমায় গাজা

বর্তমানে যাকে ইসরাইল বলা হচ্ছে, তার পুরোটাই মূলত জবরদখল করা ফিলিস্তিনি ভূমির ওপর গড়ে উঠেছে। যে জবরদখল শুরু হয়েছিল এখন থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই দখলদারিত্বের ফলে একদিকে ইসরাইলের আয়তন বড় হয়েছে; অন্যদিকে ফিলিস্তিনের আয়তন ছোট হয়েছে।

বর্তমানে ফিলিস্তিন বলতে দুই খণ্ড ভূমিকে বোঝায়। তার অপেক্ষাকৃত ছোট অংশের নাম গাজা উপত্যকা যা ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত। এটি দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশর এবং পূর্ব ও উত্তরে ইসরাইল সীমানা দিয়ে বেষ্টিত। অপর অংশের নাম পশ্চিম তীর। আর এ দুই অংশ মিলেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র। আলাদা আলাদা দুই গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত হলেও দুই অংশেই সেই ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইলি দখলদারিত্ব বলবৎ রয়েছে।

 ইউরোপজুড়ে নিপীড়িত ইহুদিরা ১৮৯৭ সাল থেকেই নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিল এবং সেই লক্ষ্যেই তারা তখন দলে দলে অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে এবং জমি ক্রয় করে বসতি গাড়তে শুরু করে।

 প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর ফিলিস্তিনের দখল নেয় ব্রিটেন। এরপর ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রথসচাইল্ডকে চিঠিও লেখেন। যে চিঠি ‍‍`বেলফোর ডিক্লারেশন‍‍` হিসেবে পরিচিত।

 এরপর ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসীদের আগমন আরও বাড়ে। জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি আসতে থাকে এবং গত কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসা ফিলিস্তিনি আরবরা তাদের সাদরেই গ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে তারা উপলব্ধি করে, তারা ধীরে-ধীরে জমি হারাচ্ছে এবং নিজেদের দেশের তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে।

ফিলিস্তিনি আরবরা তখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। কিন্তু তাদের সেই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সরকার। এদিকে ইহুদীরা নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনে বদ্ধপরিকর ছিল। ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় তারা সেই কাজ এগিয়ে নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনীর হাতে ইহুদি হত্যাকাণ্ডের পর নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর যেসব ইহুদি বেঁচে ছিলেন তাদের জন্য জন্য কী করা যায় সেটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা আরো জোরালো হয়।

 যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইসরাইল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। বিষয়টি সমাধানের জন্য ব্রিটেনের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এরপর ব্রিটেন বিষয়টিকে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য।

 ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। এতে ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিনি আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ দূরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত খারিজ করে দেয়।

 জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্তের পর ফিলিস্তিনি আরব ও ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ফিলিস্তিনি ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেন। ওইদিন রাতেই ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন ইহুদি নেতারা। ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই অবৈধ সেটেলার ইহুদি ও স্থানীয় ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে আগে থেকে চলমান সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করে এবং এক পর্যায়ে বড় যুদ্ধে রূপ নেয়।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে যোগ দেন পাঁচ আরব দেশ মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া। জেরুজালেম দখলের জন্য শুরু হয় তীব্র লড়াই। কিন্তু আরব দেশগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকায় এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় ঘটে। তবে উত্তরে সিনাই থেকে দক্ষিণে অ্যাশকেলন পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় ২৫ মাইল (৪০ কিলোমিটার) দীর্ঘ উপত্যকার দখল নেয় মিশর।

 এ সময় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে পালিয়ে গাজা উপত্যকায় আশ্রয় নেয়। এর ফলে গাজার জনসংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যায়। জনসংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ। এরপর ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গাজা উপত্যকা দখল করে ইসরাইল। যার মধ্যদিয়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কয়েক দশকের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

 এর ২০ বছর পর ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদা বা গণজাগরণ ঘটে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের বহনকারী একটি গাড়িকে চাপা দেয় ইসরাইলের একটি ট্রাক। এতে নিহত হন চারজন ফিলিস্তিনি শ্রমিক। এরপর পাথর ছুড়ে শুরু হয় প্রতিবাদ। পর্যায়ক্রমে আসে ধর্মঘট ও হরতাল।

 মিশরভিত্তিক মুসলিম ব্রাদারহুডের সহযোগিতায় গঠিত হয় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের ধ্বংস ও ইসলামি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত সংগঠন হামাস হয়ে ওঠে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) নেতা ইয়াসির আরাফাতের ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী।

 ১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক অসলো শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির অধীনে ফিলিস্তিনিদের প্রথমবারের মতো গাজা ও পশ্চিম তীরের জেরিকোতে সীমিত নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয়। কয়েক দশক নির্বাসনের পর গাজায় ফিরে আসেন ইয়াসির আরাফাত।

 তবে ২০০৬ সালে হামাসের কাছে ফাতাহর নির্বাচনী পরাজয় ঘটে। এরপর আরাফাতের উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অনুগত বাহিনীকে উৎখাত করে তারা গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দখল করে। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়ায়।

 ইসরাইল হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিকদের দেশে প্রবেশ করা বন্ধ করে দেয়া। এর ফলে তাদের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস বন্ধ হয়ে যায়। ইসরাইলি বিমান হামলায় বিকল হয়ে যায় গাজার একমাত্র বৈদ্যুতিক কেন্দ্র। যার ফলে ব্যাপক ব্ল্যাকআউট হয়। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে গাজা দিয়ে মানুষ এবং পণ্য চলাচলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসরাইল ও মিসর।

 ২০১৪ সালে ফের ইসরাইল-হামাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসরাইলের কেন্দ্রস্থলের শহরগুলোতে রকেট হামলা চালায়। পালটা বিমান হামলা ও সাঁজোয়া যান দিয়ে গাজার আশপাশের এলাকাগুলোকে ধ্বংস করে ইসরাইল। ওই যুদ্ধে ২ হাজার ১০০-এর বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি নিহত হন। অন্যদিকে ইসরাইল জানায়, সংঘর্ষে তাদের ৬৭ জন সেনা এবং ছয় বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে। 

প্রায় এক দশক পর ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধরা সীমান্ত প্রাচীর ডিঙিয়ে ইসরাইলের ভেতরে আকস্মিক হামলা চালায়। কয়েকশ লোক হত্যা এবং দুই শতাধিক ইসরাইলিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। জবাবে ভয়াবহ পালটা হামলা শুরু করে ইসরাইল।

 

গাজায় কী চায় ইসরাইল

গাজায় সামরিক আগ্রাসন শুরুর চার মাসের মাথায় ‘যুদ্ধ পরবর্তী গাজা’ নিয়ে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে ইসরাইল। পরিকল্পনা বিষয়ে দেশটির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট জানান, গাজায় ফিলিস্তিনের শাসক হবে সীমিত। হামাসকে সরিয়ে গাজার নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ নেবে ইসরাইল। গাজায় চলমান যুদ্ধ শেষ হলেই বাস্তবায়ন করা হবে এই পরিকল্পনা।

 গ্যালান্ট আরও বলেন, গাজায় ফিলিস্তিনি শাসন থাকবে সীমিত। হামাস আর গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। বরং ইসরাইলই গাজার সার্বিক নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কয়েক সপ্তাহ পর যুদ্ধপরবর্তী গাজার ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নিয়ে সরকারি পরিকল্পনা পেশ করেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু।

 মন্ত্রিসভায় তোলা নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা অনুযায়ী, অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ফিলিস্তিন এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে ইসরাইল। আর যেসব ফিলিস্তিনির সঙ্গে ইসরাইলবিদ্বেষী কোনো গোষ্ঠীর সম্পর্ক নেই, তারা গাজার শাসন পরিচালনা করবে। কেবল গাজাই নয়, অধিকৃত পশ্চিমতীরসহ জর্ডানের পশ্চিমাঞ্চলে স্থল, জল ও আকাশ পথ মিলে গোটা এলাকার নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের হাতে থাকবে।

তবে তারা যে কথাটা প্রকাশ করেনি বা প্রকাশ করার কথাও নয়, সেটা হল গাজার বিপুল গ্যাসের মজুদ। বিশ্লেষকরা চলমান যুদ্ধ ও গাজার গ্যাসের মধ্যে একটা যোগসূত্র দেখছেন। বর্তমান বিশ্বে যেসব জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহৃত হচ্ছে, তার মধ্যে গ্যাস অন্যতম। তবে এখনও কিন্তু ভূগর্ভস্থ তেলের চাইতে গ্যাসের মজুদ অনেক বেশি। তেলের মজুদ যেমন ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের অবস্থা কিন্তু তেমন নয়।

 তেল ফুরিয়ে আসলেও আরও ১২৫ বছর‌ চলতে পারার মত ভূগর্ভস্থ গ্যাস পৃথিবীতে রয়েছে। আজ হোক আর কাল এক সময় বিশ্বকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে তার আগ পর্যন্ত বা আগামী বেশ কয়েক দশক ক্ষমতাধর দেশগুলো তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হলে যে গ্যাসের উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হবে, এটা তারা জানে। কাজেই অতীতে যেমন ‘তেল যেখানে যুদ্ধ সেখানে’ প্রবাদটি সর্বজনবিদিত ছিল, আগামী কয়েক দশকে সেটা হবে, ‘গ্যাস যেখানে যুদ্ধ‌ সেখানে’।

 গাজার উপকূলে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদ রয়েছে। লেভিয়াথান গ্যাস ফিল্ড নামে যে গ্যাসক্ষেত্র, শুধুমাত্র সেখানেই রয়েছে ২২ ট্রিলিয়ন কিউবিক‌‌ ফিট গ্যাস‌। এটি বড় গ্যাস ফিল্ডগুলোর একটি মাত্র, এছাড়াও ইসরাইল, অধিকৃত ফিলিস্তিন ও তার আশেপাশে আন্তর্জাতিক জলসীমার মধ্যে এ ধরনের আরও অনেক গ্যাস ফিল্ড রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধযন্ত্র যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা ইঙ্গিত দেয় যে এই আক্রমণের লক্ষ্য কেবল হামাসকে ধ্বংস করা নয়। বরং গাজার বিশাল গ্যাসের মজুদ দখলের লক্ষ্যেই অবরুদ্ধ ভূখণ্ডটির বিরুদ্ধে নিজের সম্পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে নামার জন্য ইসরাইল একটি উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল মাত্র।

 ২০১৯ সালে গোটা পৃথিবী বিশেষ ‌করে ক্ষমতাধর দেশগুলোর চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার‌ মত একটা ঘটনা ঘটে। ওই বছর জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়, এই অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাসের মূল্য কম করে হলেও হবে ৫৩০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ অর্ধ ট্রিলিয়নের বেশী। 

 এই হিসেব হচ্ছে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের আগের হিসেব। কোভিড মহামারির আগের হিসেব, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির আগের হিসেব। বিশ্বব্যাপী এত ঘটনার পর সেই ৫৩০ বিলিয়ন ডলারের মূল্য আজকের বিশ্বে কততে দাঁড়িয়েছে, তা রীতিমতো বড় হিসাব-নিকাশের বিষয়।  

 স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটি সামনে এসে হাজির হয়েছে তা হচ্ছে, গাজা উপকূলীয় ও এর আশেপাশের আন্তর্জাতিক জলসীমার মধ্যে যে ভূগর্ভস্থ গ্যাস রয়েছে তার মালিক কে বা কারা? ধারণা করা যেতে পারে, যে ‌গ্যাস আন্তর্জাতিক জলসীমায় রয়েছে তার মালিকানা ফিলিস্তিনসহ ওই জলসীমার আশেপাশের দেশগুলোরই হবে।

 ২০১৯ সালের জাতিসংঘের ওই রিপোর্টে‌ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে‌, ইসরাইলিরা সেখানে রয়েছে মাত্র ১৯৪৮ সাল থেকে আর ফিলিস্তিনিরা রয়েছে বহু শতাব্দী ধরে। কাজেই ফিলিস্তিনিদের ওই ভূগর্ভস্থ সম্পদের উত্তরাধিকারী হওয়ার যৌক্তিকতা বহুগুণ বেশি।

 ব্রিটেনের তেল-গ্যাস কোম্পানি বিজি গ্রুপ যারা ১৯৯৯ সালে গাজার উপকূলে ওই গ্যাসের সন্ধান দিয়েছিল গ্যাস উত্তোলনের জন্যে ফিলিস্তিনি সরকার প্যালেস্টিনিয়ান অথোরিটির সঙ্গে এক প্রকার চুক্তি করেই ফেলেছিল‌। 

 যাতে তৎকালীন ইসরাইলি সরকার তেমন আপত্তি না করলেও পরবর্তীতে যখনই ইসরাইলে ডানপন্থি সরকার আসে তখনই এই চুক্তির ‌বিরোধীতা জোরদার হয়। আবার যখনই কিছুটা বাম বা অতটা ডান নয় এমন সরকার আসে তখন এই চক্রান্ত একটু দুর্বল হয়। এভাবে চলতে থাকে ফিলিস্তিনের‌ সাথে বিজি গ্রুপের‌ করা চুক্তিটি।

 ২০০৭ সালে হঠাৎ দেখা গেল‌, ফিলিস্তিনকে বাদ দিয়ে এক প্রকার পেছনের দরজা দিয়ে বিজি গ্রুপের সাথে সরাসরি যোগসাজশ করার চেষ্টা করে ইসরাইল। সেই চেষ্টা প্রথমবার ভেস্তে গেলেও খুব চটজলদি করে ইসরাইল ২০০৮ সালে ফিলিস্তিন আক্রমণ করার ঠিক আগে বিজি গ্রুপের সাথে সমঝোতা করে ফেলে।

 যুদ্ধের ঠিক আগে বিজি গ্রুপের সাথে সেই সমঝোতার ফলেই ২০০৮ সালের যুদ্ধের মধ্যে ইসরাইল গাজার উপকূলীয়‌ গ্যাসের দখল নিতে সক্ষম হয়। এরপর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার অজুহাতে গাজায় নজিরবিহীন আগ্রাসন শুরু করে ইসরাইল।

 যুদ্ধের ভেতরেই ২০২৩ সালের অক্টোবরেই ছয়টি কোম্পানিকে ১২টি লাইসেন্স অনুমোদন দেয় ইসরাইল। বলাবাহুল্য এই ছয়টি কোম্পানির মধ্যে একটি হচ্ছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম। যেখানে সরাসরি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুরকুলের পারিবারিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে।

 প্রতিবার ফিলিস্তিন আক্রমণের ঠিক আগ মুহূর্তের ঘটনাগুলোকে একটার সাথে আরেকটা মেলালে এটা স্পষ্ট হয় যে, প্রতিবারই যুদ্ধের আগে এমন কিছু ঘটে যা ইসরাইলকে একটু একটু করে ফিলিস্তিনের গ্যাস দখলে নিতে সাহায্য করে। ২০০৮ সালে যুদ্ধের‌ ঠিক আগ মুহূর্তে ইসরাইলের সাথে বিজি গ্রুপের চুক্তি ও ২০২৩ সালে ছয়টি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়ার ঘটনা তারই স্পষ্ট প্রমাণ।

কোনো যুদ্ধের ‌মধ্যে সাধারণত মোড়ল দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের সফর বেড়ে যায়। একইভাবে এবারের ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ভেতর মার্কিন এনার্জি সিকিউরিটি এডভাইজার দুবার ইসরাইল সফর করেছেন। সফরকালে তিনি বলেছেন, যুদ্ধপরবর্তী পুনর্বাসনের জন্যে ফিলিস্তিনের আর্থিক সাহায্যের লক্ষ্যে এই গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে মুনাফা ফিলিস্তিনকে দিতে হবে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এগুলোতে ফিলিস্তিনের অধিকার রয়েছে।

 যুক্তরাষ্ট্র খুব ভাল করেই জানে যে, ইসরাইল যদি ফিলিস্তিনকে তার গ্যাসের নায্য অধিকার দিত তাহলে কয়েক দশক আগেই তা দিত। কিন্তু ফিলিস্তিনকে বঞ্চিত করার জন্যে ইসরাইল বহু আগে থেকেই যুক্তি দিয়ে আসছে, ফিলিস্তিনকে গ্যাস ফিল্ডগুলোর দখল দিলে ফিলিস্তিনিরা সেখানে পাওয়া ‘অর্থ সন্ত্রাসবাদের পেছনে ব্যয় করবে’। ফিলিস্তিনকে তাই এই গ্যাসফিল্ডগুলোর মালিকানা দেয়া যাবে না।

 বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, ইসরাইলের লক্ষ্য হল গাজার অধিবাসীদের সিনাই পর্বতের দিকে ঠেলে দেয়া এবং ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণ ইসরাইলের নেতাদের সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের গাজায় সামরিক আগ্রাসন শুরুর একটা অজুহাত তৈরি করেছে। মূলত যে জায়নবাদি আদর্শের ওপর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার অস্ত্রই হল ভীতি প্রদর্শন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি আরবদের বিতাড়ন এবং ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের প্রবেশের পথ প্রশস্ত করা।

আর্কাইভ