প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৪, ১০:০৭ এএম
মাত্র দুমাস বাদে দায়িত্ব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করবেন নির্বাচনে বিজয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্সিতে তার পররাষ্ট্র নীতি কেমন হবে -- তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে বিশ্ববাসীর।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে বাণিজ্য যুদ্ধ ও সংরক্ষণবাদের মতো বিষয়গুলো। এছাড়া মার্কিন মিত্র হিসেবে পরিচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিও খুব একটা ইতিবাচক ছিল না।
এসব ব্যাপারে নিজের দ্বিতীয় মেয়াদে তার নীতি কী হবে -- তা নিয়ে দৌদ্যুল্যমানতা রয়েছে অনেকের মাঝে। তবে অতীতের মতো বর্তমান মেয়াদেও আনপ্রেডিক্টেবল ট্রাম্পের নাটকীয় কর্মকাণ্ড ও তার মনে কী চলছে সে ব্যাপারে আগাম কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যাবে না -- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষক ও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তারা।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে গোয়েন্দা পরিচালক হিসেবে কর্মরত রিচার্ড গ্রেনেল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘নিশ্চয়তা একটি ভয়াবহ জিনিস। অবশ্যই আমেরিকার শত্রুরা চায় নিশ্চয়তা। কিন্তু ট্রাম্পের ব্যাপারে পূর্বাভাস দেয়া যায় না এবং আমরা আমেরিকানরা এটাই পছন্দ করি।’
ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এ কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আসন্ন মেয়াদেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেতে পারেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম টাইম। বিভিন্ন বৈশ্বিক ইস্যুতে ট্রাম্পের মনোভাব এবং তার কর্মকাণ্ড কী হতে পারে, সে ব্যাপারে অনেকটাই ইঙ্গিত পাওয়া যায় রিচার্ড গ্রেনেলের মন্তব্যে।
তবে ট্রাম্পের এ অনিশ্চিত আচরণ সত্ত্বেও তার প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় মেয়াদে গাজা, ইউক্রেন ও ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য ইস্যু তাৎপর্যপূর্ণ ও ঘটনাবহুল হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে যে সব অঞ্চল সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পায়, তার মধ্যেই সব সময়ই অগ্রগণ্য মধ্যপ্রাচ্য। বিশেষ করে যখন এ মুহূর্তে গাজাসহ ফিলিস্তিন ও লেবাননে ভয়াবহ আগ্রাসন চালাচ্ছে যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। এরই মধ্যে এ হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৩ হাজার ফিলিস্তিনি ও ৩ হাজার লেবাননি নাগরিক।এসব সংঘাতকে ঘিরে সম্ভবত দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
অবশ্য তাকে মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাত ও সহিংসতা বন্ধ করার ব্যাপারে আগ্রহী বলেই মনে করা হচ্ছে। এমনকি গত এপ্রিল মাসে টাইমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি যদি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতেন, তবে এ যুদ্ধ হতোই না।
এছাড়া, ২০২৪ সালজুড়ে নিজের নির্বাচনী প্রচারণাতেও বারবারই এ সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন ট্রাম্প। অবশ্য কীভাবে এ শান্তি অর্জিত হবে, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো রূপরেখা দেননি তিনি। একই সঙ্গে এ মনোভাবও প্রকাশ করেন যে, তিনি গাজায় ইসরাইলকে তার কাজ ‘শেষ’ করতে দেয়ার পক্ষপাতী। আবার তার হোয়াইট হাউজে প্রবেশের আগেই নেতানিয়াহু সরকারকে এ কাজ শেষ করতে হবে -- এমন তাগাদাও দিয়েছেন তিনি।
এ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে ফিলিস্তিন ও লেবাননে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধে ট্রাম্প কী পদক্ষেপ নেবেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
অবশ্য নিজের প্রথম মেয়াদে ইসরাইলের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হিসেবেই নিজের উপস্থাপন করেছিলেন ট্রাম্প। বিশেষ করে ইসরাইলে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরসহ ইসরাইলি অধিকৃত গোলান মালভূমিকে ইসরাইলি ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এর মাধ্যমে তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যার তার পূর্বসূরী মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও নিতে সাহস পাননি।
এছাড়া ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধে একটি আলাদা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে বহুদিন ধরে আলোচিত ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধানের ব্যাপারেও ট্রাম্প খুব একটা আগ্রহী নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে গত এপ্রিল মাসে টাইম ম্যাগাজিনকে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘একটা সময় ছিল যখন আমি মনে করতাম দুই রাষ্ট্র পদ্ধতি কাজ করবে। কিন্তু বর্তমানে এই দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কঠিন, খুবই কঠিন হবে।’
অপরদিকে ইরানের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের আমলে ইসরাইল অনেক বেশি স্বাধীনতা পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ নিজের প্রথম মেয়াদে ইরানের বিরুদ্ধে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন ট্রাম্প। তিনি ইরানের পরমাণু চুক্তিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন, পাশাপাশি তেহরানের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবরোধ আরোপ করেছিলেন। ইরানের জনপ্রিয় সামরিক নেতা জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার পেছনেও ট্রাম্পের সম্মতি ছিল বলে মনে করা হয়।
তবে ট্রাম্পের আসন্ন প্রেসিডেন্সিতে সবার নজর থাকবে ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি কী পদক্ষেপ নেন তার ওপর। অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণার সময় মাত্র এক দিনের মধ্যেই ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন, এমন চমক সৃষ্টিকারী বক্তব্যও রেখেছিলেন ট্রাম্প। তবে তা কীভাবে সম্ভব সে ব্যাপারে অবশ্য তেমন কোনো ধারণা দেননি তিনি।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় বহুবারই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে আরও বেশি সামরিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প ও তার রানিংমেট জেডি ভান্স। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে প্রয়োজনে নিজের ভূখণ্ডের কিছু অংশ মস্কোকে ছেড়ে দিতে হবে- এমন মনোভাবও প্রকাশ করেছিলেন তারা দুইজনই।
এ পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে ইউক্রেনীয়দের মাঝে। তবে একই সঙ্গে আবার কেউ কেউ বাজি ধরছেন ট্রাম্পের সেই ‘ট্রেডমার্ক’ অনিশ্চিত আচরণের ওপর। তাদের ধারণা ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে রাশিয়াকে খুব বেশি না চটিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করার যে, সতর্কতামূলক নীতি বাইডেন সরকার গ্রহণ করেছিল, সম্ভবত যুদ্ধের দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে ট্রাম্প তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সাহসী এবং নাটকীয় কোনো পদক্ষেপ নেবেন।
এজন্য প্রয়োজনে কঠিন কোনো সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হবেন না ট্রাম্প এমন মনোভাবও অনেকেরই। এই মনোভাবধারীদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে স্বাগত জানিয়ে দেয়া নিজের পোস্টে বরিস জনসন দৃঢ় ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে ট্রাম্পের অতীত রেকর্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই ঘরে এবং বাইরে কিংবা মধ্যপ্রাচ্য বা ইউক্রেনই হোক না কেন, তিনি তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন।’
ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় মেয়াদে অবশ্য তার কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে অস্বস্তি তৈরি হতে পারে ইউরোপীয় ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোর মাঝে। বিশেষ করে ন্যাটো জোটের প্রতি ট্রাম্পের পুরোনো ‘উন্নাসিক’ মনোভাব তার প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় মেয়াদে পরিবর্তিত হতে পারে এমন কোনো লক্ষণ অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণার সময় চোখে পড়েনি।
ইউরোপকে রক্ষায় ওয়াশিংটন আর মুক্তহস্তে পয়সা খরচ করতে পারবে না। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের আচলের নিচে না থেকে ইউরোপকে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদেরই নিতে হবে-এমন মনোভাব অনেক আগে থেকেই প্রকাশ করে আসছেন ট্রাম্প। এমনকি যে সব ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র সামরিক বাজেট বাড়িয়ে জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করবে না। ন্যাটোর সদস্য হিসেবে যে কোনো আক্রমণের মুখে তাকে রক্ষায় চুক্তিতে বাধ্যবাধকতা থাকলেও তিনি এগিয়ে আসবেন না- পরিষ্কারভাবে এমনটাও জানিয়েছেন ট্রাম্প। এছাড়া ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সও জানিয়েছেন, ন্যাটো শুধু সেবামূলক কোনো সংগঠন নয়, এটাকে সত্যিকারের মৈত্রী জোট হতে হবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবারের মেয়াদে নিশানা হতে যাচ্ছে চীন, নির্বাচনী প্রচারণায় খোলাখুলিই এমন ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতায় গেলে চীনা পণ্যের যুক্তরাষ্ট্রে অবাধ প্রবেশ বন্ধ করতে প্রয়োজনে ৬০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপ করা হবে-এমন ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন তিনি। যদি সত্যিই হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পরপরেই নিজের অঙ্গীকার অনুযায়ী চীনের বিরুদ্ধে এই ট্যারিফ আরোপ করেন ট্রাম্প, তা হবে খোলাখুলিই চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধের ঘোষণা।
এ অবস্থায় ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীনও পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে বলেও মনে করা হচ্ছে। যদি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে এই বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তবে তা শুধু এই দুই দেশকেই ভোগাবে না, বরং পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরিবেশের ওপরই তার প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য ট্রাম্প সত্যি সত্যিই চীনের বিরুদ্ধে ৬০ শতাংশ ট্যারিফ আরোপের এই ঘোষণায় অবিচল থাকতে পারবেন কি না সে ব্যাপারে সন্দিহান অনেকেই।
বিশ্লেষকদের ধারণা, যদি সত্যিই চীনা পণ্যের ওপর এই ট্যারিফ আরোপ করা হয় তবে, প্রতিটি আগের মতো আর সস্তায় চীনা ভোগ্যপণ্য কিনতে পারবেন না মার্কিনিরা। এ অবস্থায় প্রতিটি মার্কিন পরিবারের ওপর বছরে ২ হাজার ৬০০ ডলার খরচের বাড়তি বোঝা চাপতে পারে। এতে জনপ্রিয়তা হারাতে পারেন ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান শিবির।
তবে চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই নেতিবাচক মনোভাব শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে মনে করছেন অনেকেই। বিশেষ করে তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে খুব বেশি কঠোর অবস্থানে যাবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ আগেও বহুবার তাইওয়ানকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ কী, সে প্রশ্ন তুলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে সামরিক নিরাপত্তার বিনিময়ে তাইওয়ানের থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এর খরচ আদায় করা উচিত এমন কথাও বলেছিলেন ট্রাম্প।