• ঢাকা শনিবার
    ১৯ অক্টোবর, ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

দক্ষিণ লেবাননে যেভাবে যুদ্ধ করছেন ইসরায়েলের সেনারা

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ০৭:০৭ এএম

দক্ষিণ লেবাননে যেভাবে যুদ্ধ করছেন ইসরায়েলের সেনারা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আমরা যেদিক দিয়ে লেবাননে প্রবেশ করলাম, সেদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গাড়ি এরই মধ্যে কাঁচা রাস্তা ধুলায় মিশিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের একটি এলাকার সীমান্ত বেড়ার একটি ফোকর দিয়ে আমরা লেবাননে প্রবেশ করি। এক প্রজন্ম আগে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতির চিহ্ন হিসেবে সীমান্ত তৈরি করা হয়েছিল। স্বয়ং এ যুদ্ধবিরতি ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে।

এই সীমান্ত ধরে গত সপ্তাহে লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। দেশটি বলেছে, হিজবুল্লাহর অস্ত্রশস্ত্র ও অবকাঠামো ধ্বংস করতে ‘সীমিত আকারে, স্থানীয়ভাবে ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তল্লাশি’ চালানো হচ্ছে।

ইসরায়েল সেনাবাহিনী আমাদের লেবানন সীমান্তের কয়েক মাইল ভেতরের একটি গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামটিতে তাঁরা সবে ‘কিছুটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’ করেছে।

গ্রামটি কোথায় তা সামরিক কারণে আমাদের গোপন রাখতে বলা হয়েছিল। আমাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল।

আমরা যখন পৌঁছাই, তখন ইসরায়েলের গোলন্দাজ বাহিনী গোলা ছুড়ছিল। এলাকাটা এখনো হিজবুল্লাহর যোদ্ধামুক্ত নয় বলে জানান ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল ইয়ানিভ মালকা। ইয়ানিভ মালকা বলেন, আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে ৫০০ মিটার দূরে যুদ্ধ চলছিল। সেখান থেকে ছোট অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছিল। কয়েক দিন আগের এই লড়াইকে গ্রামটির ভেতরে হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের সঙ্গে ‘হাতাহাতি লড়াই’ বলে বর্ণনা করলেন এই ইসরায়েলি কমান্ডার। তিনি বলেন, ‘আমার সেনারা (হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের) নিজেদের চোখে দেখছিলেন; এবং রাস্তায় তাঁদের সঙ্গে লড়াই করছিলেন।’

গ্রামটির ভেতর দিয়ে যাওয়া প্রধান রাস্তা বরাবর (দুই পাশের) সব বাড়িঘর বিধ্বস্ত। ধ্বংসস্তূপ থেকে গার্হস্থ্য জীবনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। যেসব ভবন তখনো খাড়া ছিল সেগুলো কামানের গোলা দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল।

একসময় যেখানে গ্রামের চত্বর ছিল, সেখানে ওলটপালট মাটির কাছে দুটি ট্যাংক দাঁড়ানো। তাদের চারপাশে ধ্বংসের যে মাত্রা তা গাজার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গ্রামটির একটি নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে যেতে সেনাবাহিনী আমাদের নিষেধ করেছিল; কিন্তু দূর থেকে আশপাশের ভবন ও বসতিগুলো দেখে অক্ষত মনে হচ্ছিল।

এখানে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এসব হামলা সামরিক দিকের চেয়ে ভৌগোলিকভাবে বেশি ‘সীমিত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু’–কেন্দ্রিক বলে মনে হচ্ছিল। সেনাদের দখল করা একটি বাড়িতে একটি দেয়াল লিখন এ রকম, ‘আমরা চেয়েছিলাম শান্তি, তোমরা চেয়েছ যুদ্ধ।’

কর্নেল ইয়ানিভ আমাকে বলেছেন, ‘বেশির ভাগ সন্ত্রাসী পালিয়ে গেছে; কিন্তু অনেক বাসায় বিস্ফোরকের ফাঁদ (বুবি-ট্র্যাপ) পেতে রাখা হয়েছিল। আমরা বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পর এসব ফাঁদ ও অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান পেলাম। এসব বাড়ি ধ্বংস করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।’

এখানে যা ঘটেছিল, সে বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বয়ান ছাড়া আমাদের কিছু জানা সম্ভব ছিল না। আমি সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্রের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, যখন অভিযান শুরু হয়েছিল, তখন এখানে কোনো নারী বা শিশু ছিল কি না? তিনি উত্তর দিলেন, সব বেসামরিক মানুষকে চলে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সতর্ক করা হয়েছিল।

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল চলতি সপ্তাহে দক্ষিণ লেবানন থেকে (সাধারণ মানুষ) সরিয়ে নেওয়ার ইসরায়েলি সতর্কতাকে অপর্যাপ্ত ও অতি সাধারণ বলে জানিয়েছে এবং বলেছে, এসব সতর্কতা দেশটিকে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা থেকে দায়মুক্তি দেয় না।

বেসামরিক মানুষের বাসায় পাওয়া তিনটি অস্ত্রের গুপ্ত ভান্ডার আমাদের দেখানো হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েক বাক্স একদম নতুন মর্টার, নতুন ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও মাইন ছিল। এ ছাড়া কাঁধ থেকে ছোড়া যায় এমন অত্যাধুনিক রকেট ও অন্ধকারে দেখার সরঞ্জাম (নাইট-স্কোপও) উদ্ধার করা হয়েছিল। আমরা অর্ধপ্রস্তুত করা একটি ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে পেয়েছিলাম।

ইসরায়েলের ৯১তম ডিভিশনের চিফ অব স্টাফ রয় রুসো আমাদের একটি গ্যারেজ দেখালেন। এটি সরঞ্জামের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এতে একটি বড় ব্যারেলে লুকিয়ে রাখা বিছানা, শরীরের বর্ম, রাইফেল ও গোলাবারুদ ছিল।

রয় রুসো বললেন, ‘আমরা এটাকেই হাতবদলের এলাকা বলি। তাঁরা বেসামরিক মানুষ থেকে যোদ্ধায় পরিণত হচ্ছে। এসব সরঞ্জাম ইসরায়েলে প্রবেশ ও অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। এসব প্রতিরক্ষামূলক কোনো সরঞ্জাম নয়।’

ইসরায়েল বলেছে, তারা এই কারণেই দক্ষিণ লেবাননে অভিযান শুরু করেছে। এই সীমান্ত এলাকাজুড়ে হিজবুল্লাহ অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম মজুত করেছিল সীমান্ত পার হয়ে এসে ইসরায়েলে হামলা চালানোর জন্য। গত বছরের ৭ অক্টোবর যেভাবে দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস।  

এই স্থল অভিযানের শুরুতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, লেবাননের সীমান্ত এলাকাজুড়ে ছোট কৌশলগত ইউনিট দিয়ে প্রায় এক বছর ধরে ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনী অভিযান পরিচালনা করেছে। হিজবুল্লাহর অবকাঠামো খুঁজে পেতে ও ধ্বংস করতে তারা ৭০টির বেশি তল্লাশি চালিয়েছে। অবকাঠামোর মধ্যে সুড়ঙ্গও রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি রেখার ১০০ ফুট দূরে এসে থেমে গেছে, এমন একটি অসমাপ্ত টানেলের সন্ধান পাওয়া গেছে।

আমরা যেদিন এসেছি, সেদিন পাওয়া গেছে এমন কিছু অস্ত্রশস্ত্র কর্নেল ইয়ানিভ আমাকে দেখালেন। এর মধ্যে ছিল একটি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি), একটি মানবধ্বংসী মাইন এবং একটি উন্নত প্রযুক্তির নাইট-স্কোপ। তিনি বলেছেন, সেনারা গাজায় যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছিলেন, এখানে তার চেয়ে ‘দুই থেকে তিন গুণ’ বেশি অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। শুধু এই গ্রামেই পাওয়া গেছে হাজার হাজার অস্ত্রশস্ত্র ও হাজার হাজার গোলাবারুদ।

তিনি আমাকে বলেছেন, ‘আমরা এসব জায়গা দখল করে রাখতে চাই না। আমরা এসব গোলাবারুদ ও লড়াইয়ের সরঞ্জাম এখান থেকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের আশা, এরপর লোকজন ফিরে আসবে। তারা বুঝতে পারবে শান্তি তাদের জন্য ভালো। আর তাদের ওপর সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ খারাপ।’

‘বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা হবে, তা আমি কূটনীতিকদের হাতে ছেড়ে দেব,’ তিনি হাসলেন।

ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বশেষ স্থল যুদ্ধ হয়েছিল ২০০৬ সালে। তখন জাতিসংঘ নির্দেশ দিয়েছিল, হিজবুল্লাহকে অবশ্যই লিতানি নদীর উত্তরে ফিরে যেতে হবে। এর আগের এক নির্দেশে গোষ্ঠীটিকে নিরস্ত্র হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়নি।

২০০৬ সালের যুদ্ধ ছিল ইসরায়েলের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। ইসরায়েল সেনাবাহিনীকে তখন এক পা-ও নড়তে না দেওয়াই ছিল ইরানের সমর্থনপুষ্ট আধা-সামরিক বাহিনীটির লক্ষ্য। এরপর প্রায় ২০ বছর উভয় পক্ষ এড়িয়ে এড়িয়ে পরবর্তী (যুদ্ধের) জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে।

ওই যুদ্ধে কর্নেল মালকা অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘এবারেরটা ভিন্ন।’

কেন জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, ‘৭ অক্টোবরের কারণে।’

আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন ছোট অস্ত্রের শব্দ ক্রমে বাড়ছিল। তিনি ওদিকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমার ছেলেরা পুরোনো শহরের (কসবা) দিকে লড়াই করছে।’

গত তিন সপ্তাহ ধরে লেবানন ও বৈরুতের কিছু অংশে ব্যাপক বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান স্থল অভিযান সেই নাটকীয় তীব্রতা বৃদ্ধির অংশ।

লেবানন বলেছে, সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলায় সেখানে ২ হাজার ২০০ এর বেশি মানুষ মারা গেছে। স্থানচ্যুত হয়েছে ১০ লাখের বেশি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ