প্রকাশিত: অক্টোবর ৮, ২০২৪, ১০:১২ এএম
ক্ষমতায় আসার পর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু সামুদ্রিক টহলকাজে সহযোগিতার জন্য দেশটিতে থাকা ভারতীয় সেনাদের একটি দলকে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেন। এরপর বেইজিংয়ের সঙ্গে সামরিক চুক্তি সই করে মালে। এ নিয়ে ভারত মহাসাগরে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে নয়াদিল্লি। মালদ্বীপকে সব সময় নিজেদের প্রভাব বলয়ের এলাকা হিসেবে দেখে আসছে ভারত।
এ অবস্থার মধ্যে পাঁচ দিনের ভারত সফর শুরু করেছেন মলদ্বীপের প্রেসি়ডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। রোববার বিকালে তিনি দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছান। মুইজ্জুর সঙ্গে সফর করছেন তার স্ত্রী সাজিদা মোহাম্মদও।
এ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে মুইজ্জুর। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট পদে বসে ‘ভারত বিরোধী’ পথে হাঁটা মুইজ্জুর এ সফর কূটনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
ভারত সফররত মুইজ্জু তার দেশকে বিপুল আর্থিক সহায়তা করার জন্য ভারতকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সোমবার দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠকের পর করা এ মন্তব্যকে মুইজ্জু সরকারের তীব্র ভারত-বিরোধিতার নীতি থেকে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে এদিনের বৈঠকের পর মোদি জানান, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সংযোগ, কানেক্টিভিটি, সাংস্কৃতিক কানেক্ট-সহ আরও বহু খাতে সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে তাদের দু’জনের মধ্যে বিশদে আলোচনা হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জানিয়েছে, ভারত-মালদ্বীপ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৬০ বছর বা হীরক জয়ন্তী বর্ষ উদযাপনে আগামী বছর মালদ্বীপ সফর করার জন্য প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি তা গ্রহণ করেছেন।
বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বলেন, ‘আমাদের দুই দেশে তথা গোটা অঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের প্রতি অভিন্ন অঙ্গীকারে মালদ্বীপ ও ভারতের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।’
গত বছর মালদ্বীপে নির্বাচনি প্রচারণার সময় তীব্র ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন চালিয়ে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, সেই মোহামেদ মুইজ্জুর সরকারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘বাঁক বদলের পদক্ষেপ’ বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
এদিকে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএনআই আরও জানিয়েছে, ‘ভারত সরকার যে আমাদের ৩০০০ কোটি রুপি (৩৬ কোটি ডলার) আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এবং তার পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক স্তরে ৪০ কোটি ডলারের ‘কারেন্সি সোয়াপ’ (মুদ্রা বিনিময়) সমঝোতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
মালদ্বীপ এই মুহূর্তে যে বৈদেশিক মুদ্রা বা ফরেন রিজার্ভ সংকটের সম্মুখীন, তার মোকাবিলায় এ সিদ্ধান্ত সহায়ক হবে বলেও প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু মন্তব্য করেছেন।
রোববার ভারতে এসে পৌঁছানোর আগে বিবিসিকে দেওয়া এক ই-মেইল সাক্ষাৎকারেও প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বলেছিলেন, তার দেশের আর্থিক পরিস্থিতির ব্যাপারে ভারত অবহিত এবং সেই সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টায় ভারত তাদের নিশ্চিতভাবেই সহায়তা করবে।
সোমবার ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সফর শুরু হওয়ার পর এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তার বৈঠকের পর দেখা গেল, সেই ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রবল আর্থিক সংকটের মুখে পড়া মালদ্বীপকে ভারত নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারতে মুইজ্জুর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর
গত বছর মালদ্বীপের ক্ষমতায় আসার পর এটাই ভারতে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। তবে মাস চারেক আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি দিল্লি এসেছিলেন।
চলতি সফরে রোববার সন্ধ্যায় দিল্লি এসে পৌঁছানোর পর এদিন (সোমবার) সকালে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু।
তাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
এরপর প্রথা অনুযায়ী ভারতের জাতীয় জনকের সমাধিস্থল রাজঘাটে শ্রদ্ধার্পণ করে তিনি দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
বৈঠকের পর দু’দেশের পক্ষ থেকে জারি করা হয় একটি যৌথ বিবৃতি। হায়দ্রাবাদ হাউসে দুই নেতার যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি ভারতকে ওই দ্বীপরাষ্ট্রের ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ হিসেবে তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, তার সরকারের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ নীতির কারণেই মালের যেকোনো বিপদে আপদে ভারত ‘ফার্স্ট রেসপন্ডারে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে– অর্থাৎ অন্য সবার আগে তাদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
‘নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগানোই হোক, কোভিড মহামারির সময় ভ্যাক্সিন পাঠানো কিংবা পানীয় জলের ব্যবস্থা করা– ভারত সব সময় ভালো প্রতিবেশীর মতো আচরণ করেছে,’ মনে করিয়ে দেন তিনি।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মালদ্বীপের যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সে কথাও উল্লেখ করেন নরেন্দ্র মোদী।
৩০০০ কোটি রুপির ‘কারেন্সি সোয়াপ’
বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভারতকে যে সব কারণে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, তার মধ্যে সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ৩০০০ কোটি রুপির (যা প্রায় ৪০ বিলিয়ান ডলারের সমতুল্য) একটি কারেন্সি সোয়াপ এগ্রিমেন্ট।
বিগত কয়েক মাসের মধ্যে মালদ্বীপের ‘ফরেন রিজার্ভ’ বা বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় হু হু করে কমেছে– শেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তাদের রিজার্ভ এখন মাত্র ৪৪ কোটি ডলারে এসে ঠেকেছে।
এই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে মালদ্বীপ বড়জোর পরবর্তী দেড় মাসের আমদানি খরচ মেটাতে পারবে।
যে দেশটিকে জ্বালানি তেল থেকে চাল-গম প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, তাদের জন্য এটি একটি বিরাট সংকট নিঃসন্দেহে।
গত মাসে বৈশ্বিক সংস্থা মুডি’জ-ও তাদের মূল্যায়নে মালদ্বীপের ক্রেডিট রেটিংয়ে অবনমন ঘটিয়ে জানিয়েছিল, সে দেশের ‘ডিফল্ট রিস্ক’– অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণ মেটাতে ব্যর্থ হওয়া বা ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা– মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
আজ দিল্লিতে দুই দেশের মধ্যে যে আর্থিক সমঝোতা হলো, তার ফলে দু’পক্ষ তাদের মধ্যকার ঋণের ‘সুদ’ ও ‘আসল’ – উভয়ই ডলারের পরিবর্তে নিজস্ব মুদ্রায় পরিশোধ করতে পারবে, আর সেটা হতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে।
এর ফলে মালদ্বীপের ডলার রিজার্ভের ওপর এই মুহূর্তে যে প্রবল চাপ, সেটা অনেকটা প্রশমিত হবে। প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু নিজেও সে কথা আজ স্বীকার করেছেন।
এছাড়া ভারতের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কনসর্টিয়াম ‘ন্যাশনাল পেমেন্টস করপোরেশন অব ইন্ডিয়া’ মাস্টারকার্ড ও ভিসার বিকল্প হিসেবে যে ‘রূপে’ পেমেন্ট কার্ড চালু করেছে– সেটাও অচিরেই মালদ্বীপে ব্যবহারযোগ্য হবে বলে এদিন সমঝোতা হয়েছে।
মালদ্বীপের রাজধানী বৃহত্তর মালে এলাকায় বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পর উন্নয়নেও ভারত তাদের সহযোগিতা করবে বলে কথা দিয়েছে।
‘ভারত আমাদের সমস্যার কথা জানে’
দিল্লির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগেই অবশ্য প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, ভারত যে তাদের অর্থনৈতিক সংকটে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।
পাঁচ দিনের এই দীর্ঘ ভারত সফরে রওনা হওয়ার আগে দেওয়া এক ইমেইল সাক্ষাৎকারে তিনি এই আত্মবিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন।
বিবিসির আনবারাসান এথিরাজনকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত সম্পূর্ণরূপে অবহিত।
‘মালদ্বীপের বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ভারত- আর আমাদের বোঝা লাঘব করতে, উন্নততর বিকল্প এবং আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান খুঁজে পেতে তারা সব সময় প্রস্তুত,’ মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তীব্র ভারত-বিরোধী যে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনে ভর করে মোহামেদ মুইজ গত বছর ক্ষমতায় এসেছিলেন তার তুলনায় দিল্লির প্রতি তার এই সুর নরম করার ইঙ্গিত ‘সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী’।
তথাকথিত ভারত-বিরোধী মনোভাব নিয়ে বিবিসির কাছে প্রেসিডেন্ট মুইজ অবশ্য খোলাখুলি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
তবে তিনি এটুকু শুধু বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলে খোলাখুলি আলোচনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে তা মিটিয়ে নেওয়া যাবে বলে আমরা নিশ্চিত।’
মালদ্বীপ যে তাদের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) দ্বারস্থ হওয়ার কথা বিবেচনা করছে না, সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট মুইজ সে কথাও স্পষ্ট করে দেন।