প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২৩, ০৭:২২ পিএম
অভ্যন্তরীণ কাঁচামাল সংকট, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, চাহিদা কমে যাওয়া এবং সরকারি পর্যায়ে সহযোগিতার অভাবে অনকে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন ভারতের টেক্সটাইল শিল্প মালিকরা। এই পরিস্থিতিতে রফতানি আয় কমে যাওয়ায় দেশটির সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন অনেকে।
শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শিবকুমার ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের কোয়েম্বাটুর শহরের একটি ফাউন্ড্রির (ঢালাই শিল্পের) পরিচালক। রাজ্যের দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে তার কারখানার জন্য স্ক্র্যাপ (ভাঙারি) কেনা হয়। সম্প্রতি তিনি একটি টেক্সটাইল কারখানা থেকে ২৫০ টন স্ক্র্যাপ কিনেছেন, যা রাজ্যের কোয়েম্বাটুর থেকে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টার দূরত্বে।
তামিলনাড়ুর সোমানুর পাওয়ারলুম ক্লাস্টারের তাঁতি কান্দাসামি জানান, তাদের গ্রামে প্রতি মাসে ১০টির বেশি তাঁত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ভারতের তুলা ফেডারশেনের (আইসিএফ) সভাপতি জে. থুলসিধরন বলেন, তামিলনাড়ুতে একই ধরনের আরও অনেক গল্প রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের (এমএসএমই) বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের বর্তমান এই দুর্দশা ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে দেখা গিয়েছিল।
বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কলকারখানা
গত কয়েক মাসে তামিলনাড়ুতে বেশকিছু টেক্সটাইল কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার অনেকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়েছে, শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিয়েছে যা তাদের বেতনে প্রভাব পড়েছে। সবমিলিয়ে শিল্প উৎপাদন সূচকে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প সঙ্কুচিত হয়েছে।
ভারতের অন্ধ্রপদেশের এপি টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান পি. কোটি রাও বলেছেন, গত কয়েক মাসে অন্তত ৮-৯টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও কয়েকটি বন্ধের পথে।
তিনি বলেন, এটি (টেক্সটাইল শিল্প) অন্ধ্র প্রদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্প। আমরা উৎপাদিত সুতার ৩০ শতাংশ রফতানি করতাম। এখন এটি পাঁচ শতাংশও সম্ভব হচ্ছে না। তুলার দাম বেশি, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কাছ থেকেও কোনো সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি বছর তুলা মৌসুমে খুচরা বিক্রয় গত বছরের তুলনায় সমান হলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেক কম। চলতি বছরের এপ্রিল-অক্টোবরে রফতানি বাণিজ্যে টেক্সটাইলের চালান শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ কমেছে, যা গত বছরের একই সময়ে ২৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
গত অক্টোবরে পোশাক রফতানি ৮ দশমিক ০৮ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল-অক্টোবরে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ কমেছে।
কমেছে পোশাক রফতানি
গত বছরের আগস্ট থেকে ভারতে পোশাক রফতানি কমতে শুরু করে। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ক্রয়কারী দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি এবং খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বড় ইনভেন্টরি অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে প্রতিযোগিতামূল বাজারে ভারতীয় টেক্সটাইল এবং পোশাক শিল্পের এই অবস্থার জন্য একাধিক সমস্যা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কাঁচামালের দাম, ইনপুট খরচ বৃদ্ধি, গুণমান নিয়ন্ত্রণ আদেশ (কিউসিও) এবং পোশাক আমদানি।
সাউদার্ন ইন্ডিয়া মিলস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এসকে সুন্দররামন বলেছেন, ফাইবারের কাঁচামাল উৎপাদন ব্যয়ের ৬০-৭০ শতাংশ, যা ভারতে ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এটি শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
ভারতীয় বস্ত্র খাত মূলত তুলাভিত্তিক। বর্তমানে দেশটিতে তুলার উৎপাদন ও ফলন নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০১৩-১৪ তুলা মৌসুমে উৎপাদন ও ফলন যথাক্রমে ৩৯৮ লাখ বেল এবং ৫৬৬ কেজি প্রতি হেক্টরে পৌঁছেছিল।
২০২১-২২ সালে প্রকৃত উৎপাদন ছিল ৩১০ লাখ বেল এবং ফলন প্রতি হেক্টরে ৪৫১ কেজি। ২০২১ সালে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ আরোপ করার ফলে সেই বছর তুলার দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এরপর গত অক্টোবর থেকে পতন ঘটে। যা কৃষক এবং শিল্প খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আইসিএফের সচিব নিশান্ত আশিস জানিয়েছেন, সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত ভারসাম্যপূর্ণ এবং দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত, যা কৃষক ও ভোক্তা শিল্পকে উপকৃত করবে। ২০০৮ থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত তুলার ওপর আমদানি শুল্ক করত না।
জানা গেছে, মানবসৃষ্ট ফাইবার (এমএমএফ) অভ্যন্তরীণ সরবরাহ সীমিত এবং কিউসিও প্রবর্তন শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আশিস বলেন, গুজরাটের একজন তাঁত ইউনিটের মালিক টেক্সটাইল শিল্পের গড় ক্ষমতা ব্যবহার ৭০ শতাংশ ৷ আমরা প্রায় ২০ শতাংশ ফিলামেন্ট সুতা আমদানি করতাম। এখন কিউসিওর কারণে পারি না। গত দুই মাসে সুতার দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে।
আশিস এবং আরেক বস্ত্র রফতানিকারক সঞ্জয় জৈন মনে করেন, সরকারের উচিত ছিল ফাইবারের পরিবর্তে গার্মেন্টস এবং ফেব্রিক্সের ক্ষেত্রে কিউসিও চালু করা। ফাইবার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও মূলত বাংলাদেশ থেকে কাপড় ও পোশাক আসছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৩ হাজার ২৪৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ফেব্রিক্স, পোশাক ও হোম টেক্সটাইল আমদানি করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মোট টেক্সটাইল আমদানি হয়েছে ৬ হাজার ৯৬৭ মিলিয়ন ডলার।
তামিলানাড়ুর তিরুপুরের পালানিসামি আন্ডারগার্মেন্ট তৈরি করেন এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে সেগুলো বিক্রি করেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি কেরালার একজন ক্রেতা আমাকে বাংলাদেশের তৈরি একটি টুকরো দেখালেন। এটির দাম ২৫ রুপি, যা আমাদের এখানে ৩০ রুপি।
ক্লোথিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার প্রধান মেন্টর রাহুল মেহতারের মতে, যারা দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা করে তারা আমদানির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকায় সেই পোশাকগুলো ভারতে ১৫-২০ শতাংশ কম দামে পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক বাজারেও ভারতীয় পোশাক রফতানিকারকরা মূল্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ক্রেতারা খরচ সচেতন এবং বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের সাম্প্রতিক মজুরি বৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারতীয় রফতানিকারকরা অর্ডারে বড় পরিবর্তন আশা করছেন না। ভারতীয় এবং বাংলাদেশের পোশাকের মধ্যে সামগ্রিক খরচের পার্থক্য প্রায় ২-৩ শতাংশ হওয়া উচিত, কিন্তু বাংলাদেশে শ্রম খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ কম। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকায় ভারতীয় রফতানিকারকরা প্রবেশ করতে পারছেন না।
কটন টেক্সটাইল এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক সিদ্ধার্থ রাজাগোপাল বলেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ের পর প্রচুর চাহিদা ছিল এবং সাপ্লাই চেইন জুড়ে দাম বাড়তে শুরু করে। এটি দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করেছিল এবং সক্ষমতা দ্রুত যুক্ত হয়েছিল। কিছু রাজ্য টেক্সটাইলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। তবে ভর্তুকি বেশিদিন চলতে পারে না এবং শ্রম বা বিদ্যুতের খরচ বাড়বে। শিল্পের প্রতিযোগিতার উন্নতির জন্য মেট্রিক্স তৈরি করা উচিত।
শক্তিভেল নামে একজন রিয়েলেটর বলেন, ত্রিপুরার মতো ক্লাস্টারগুলো যেখানে অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি বস্ত্র শিল্প, পরিবহন, খুচরা বিক্রয় এবং রেস্তোরাঁ, সেগুলো এখন ক্ষতির সম্মুখীন। আমার গোডাউনে প্রায় এক বছর ধরে কোনো ক্রেতা নেই।
তিনি আরও বলেন, মুথুপান্ডি নামে এক শ্রমিক একটি রফতানি হাউসে দিনে ১ হাজার পিস পোশাক সেলাই করতেন, এক পিসের জন্য ৫০ পয়সা পেতেন তিনি। তবে এখন তার কাজ ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
তবে আশার কথা হলো গত জুলাই মাস থেকে তুলার সুতা, কাপড়, তৈরি ও তাঁতের রফতানি উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।
সুতা তৈরির কাঁচামাল রফতানি স্বাভাবিক হচ্ছে এবং হোম টেক্সটাইল বৃদ্ধির নেতৃত্ব দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে শিল্পের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো কেন্দ্র এবং রাজ্য পর্যায়ে নীতিগত সহযোগিতা এবং প্রতিযোগিতার উন্নতির জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা, যোগ করেন তিনি।
জেকেএস/