• ঢাকা শুক্রবার
    ০৮ নভেম্বর, ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

যে কারণে চীনের ‘পুরোনো বন্ধু’ ছিলেন কিসিঞ্জার

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৩, ০৬:১১ পিএম

যে কারণে চীনের ‘পুরোনো বন্ধু’ ছিলেন কিসিঞ্জার

ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মৃত্যুর ঘটনায় প্রশংসা আর স্মৃতিচারণে ভাসছে চীন, যদিও দেশ দুটির মধ্যে পরস্পরবিরোধী সম্পর্ক বিরাজ করছে। ‘আপনি সব সময় চীনের জনগণের বন্ধু, শান্তিতে ঘুমান’ এটি চীনের সামাজিকমাধ্যম ওয়েবুতে সবচেয়ে বেশি লাইক পাওয়া কমেন্ট। ২৯ নভেম্বর কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর চীনের সামাজিকমাধ্যমে যেসব কমেন্ট এসেছে তার বেশির ভাগেই তাকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সুন্দর করার সময় থেকে একজন পুরোনো ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবেই সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে।

হেনরি কিসিঞ্জারকে নিয়ে কেন এত বেশি আবেগপ্রবণ চীনারা? এর কারণ তার চেষ্টায় ১৯৭৯ সালে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে আলোচনা শুরুর আগে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। যদিও সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সময়ে। তবে তার আগে রিচার্ড নিক্সন ছিলেন প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ১৯৭২ সালে বেইজিংয়ে তার ঐতিহাসিক সফরে গিয়ে মাও জেদং এর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এটি কয়েক দশকের উত্তেজনার অবসান ঘটায়।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য দাঁড় করান। আর এটিই পশ্চিমের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে চীনের সিদ্ধান্ত নেওয়াকে প্রভাবিত করে। ১৯৭১ সালে তিনি নিজেই বেইজিং যান নিক্সনের বৈঠকের ব্যবস্থা করতে। ঐ সময়টিতে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গেও আলোচনার চেষ্টা করছিল এবং আশা করছিল যে, চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এবং উত্তেজনা কমাতে ভূমিকা রাখবে। চীনের মানুষের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত আমেরিকান। দেশ জুড়ে এখন ইতিহাসের ক্লাসেও তার নাম বলা হয় এবং অনেকেই তাকে দেখেন বন্ধুভাবাপন্ন পশ্চিমা হিসেবে। তার কয়েক দশকের ক্যারিয়ারে চীনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের বিভিন্ন বিষয়ে যে সংশ্লিষ্টতা সেটিই তাকে মনে রাখার মতো কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০১১ সালে চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্কারে কিসিঞ্জার বলেছিলেন, চীন হলো সেই দেশ যার সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময়ের এবং গভীর যোগাযোগ আছে। চীন আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। বিদেশি অল্প কয়েক জন নেতার মধ্যে তিনি একজন যিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পাঁচটি প্রজন্ম অর্থাত্ মাও থেকে শি জিনপিং এর সঙ্গে কাজ করেছেন।

ওয়েবুতে এক পোস্টে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন সিসিটিভি তাকে উল্লেখ করেছেন ‘লিভিং ফসিল’ হিসেবে। যিনি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আছেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার সমর্থন ছিল দারুণ শক্তিশালী। তিনি ১৯৮৯ সালে তিয়েনমান স্কোয়ারে ছাত্র বিক্ষোভে নৃশংস দমন অভিযানকে ‘অনিবার্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে এক লেখায় তিনি লিখেছিলেন, এই নৃশংসতা ছিল দুঃখজনক। কিন্তু তিনিই আবার সেখানে লিখেছিলেন, দুনিয়ার কোনো সরকারই তার রাজধানীর একটি প্রধান চত্বর আট সপ্তাহ ধরে লাখ লাখ বিক্ষোভকারীদের দখল করে রাখাকে মেনে নিবে না। তিনি লিখেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে—আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তার এমন ইস্যুতে চীন আমেরিকার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও কিসিঞ্জারকে বারবার ডাকা হয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে। তিনি এটা করে গেছেন সারা জীবন ধরেই—এমনকি যখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ও আমেরিকার ক্ষমতার অন্যতম চ্যালেঞ্জার হয়ে গেছে তখনো। তাকে সব সময়ই বেইজিংয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গেছেন। তিনি ১০০ বারের বেশি চীন সফর করেছেন। অবসরের অনেক পরে তিনি শেষ সফর করেছেন গত জুলাইয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বিরাজ করা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজে তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। শি তাকে বলেন যে, চীন কখনো ‘আমাদের পুরোনো বন্ধুকে’ ভুলবে না।

১৯৭৯ সালে যখন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয় তখন যুক্তরাষ্ট্র স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার চিন্তা থেকে সরে আসে এবং ‘এক চীন’ নীতিতে সম্মতি দেয়। কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের বরফ গলাতে সহায়তা করেছিলেন। এর পরের ৫০ বছরে দুই দেশের সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে যদিও সাম্প্রতিককালে সেই সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনকে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং চীনকে ঠেকাতে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ, বাণিজ্য সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাইওয়ান প্রশ্নে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার পথ বেছে নিয়েছে।

গত জুলাইতে কিসিঞ্জারের সফরের সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছিলেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত কিসিঞ্জারের কৌশলগত ভিশন, রাজনৈতিক সাহস ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশটির শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই বলেছিলেন, চীনা নীতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার ‘কিসিঞ্জার স্টাইল কূটনৈতিক প্রজ্ঞার’। কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রাষ্ট্রদূত শিয়ে ফেং বলেছেন, শতবর্ষী মানুষটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন তা ইতিহাস মনে রাখবে।

 

সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন

 

জেকেএস/

আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ