প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৩, ০৭:৫২ পিএম
ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মৃত্যু হয় ২৪ আগস্ট। তবে এ মৃত্যুতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। এখন প্রশ্ন— কেন পুতিন এ ধরনের প্রতিশোধ নিল? এটির উত্তর পেতে হলে আগে জানতে হবে পুতিনের সঙ্গে প্রিগোজিন কীভাবে বন্ধুত্ব থেকে শত্রুতে রূপ নিয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা তখন খুবই নাজুক। সেই সময় দেশটির সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় ভ্লাদিমির পুতিনের।
তিনি তখনো রাশিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে আসেননি। আর প্রিগোজিনের হাত ধরে ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপও গড়ে ওঠেনি।
সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে জন্ম পুতিন ও প্রিগোজিনের। শহরটিকে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও বলা হয়। সেখানে রয়েছে রাশিয়ার বিখ্যাত হারমিটেজ আর্ট মিউজিয়াম ও ইম্পেরিয়াল উইন্টার প্যালেস। সেন্ট পিটার্সবার্গের আরেকটি পরিচয় আছে, তা হলো— এ শহর রাশিয়ার অপরাধের রাজধানী, শক্তিশালী সব অপরাধী চক্রের ঘাঁটি।
সেন্ট পিটার্সবার্গে পুতিন ও প্রিগোজিনের প্রথম সাক্ষাৎ কোন ঘটনাচক্রে হয়েছিল, তা জানা যায়নি। প্রিগোজিন তখন সবেমাত্র কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আর সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে এক অভিযান শেষ করে দেশে ফিরেছেন পুতিন। এর পর পা রাখার চেষ্টা করছেন রাজনীতিতে।
প্রিগোজিন প্রথম অপরাধী হিসেবে সাজা পান মাত্র ১৭ বছর বয়সে। তাই অপরাধ জগৎ তার কাছে ততটাও অচেনা ছিল না। সত্তরে দশকে চুরির অপরাধে সাজা হয় তার। তবে পরে ওই সাজা মওকুফ করা হয়। এর পর ১৯৮১ সালে ডাকাতির অভিযোগ ওঠে প্রিগোজিনের বিরুদ্ধে। সেবার আর পার পাননি। কারাগারে থাকতে হয় লম্বা সময়ের জন্য।
১৯৯০ সালে যখন প্রিগোজিন সাজা খেটে কারাগার থেকে বের হন, তত দিনে রাশিয়ায় চিত্রপট অনেকটা বদলে গেছে। সোভিয়েত নেতা লিওনিড ব্রেজনেভের জায়গায় ক্ষমতায় এসেছেন সংস্কারপন্থি নেতা মিখাইল গর্ভাচেভ।
প্রিগোজিন তখন সেন্ট পিটার্সবার্গে হটডগ বিক্রি শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন তিনি। নাম রাখেন ‘দ্য ওল্ড কাস্টম হাউস’। ধারণা করা হয়, সেখানেই পুতিনের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল।
এদিকে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। এই সময় ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনারের নাম শোনা যায়। সেই সময় ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করছিলেন ওয়াগনার যোদ্ধারা। প্রেসিডেন্ট পুতিনের কর্তৃত্ববাদকে সুসংহত করতে সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন প্রিগোজিন ও তার প্রতিষ্ঠান। যদিও রাশিয়ার আইনে এমন ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ ছিল।
শুধু ইউক্রেন নয়, সিরিয়াতেও রাশিয়ার হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ওয়াগনার। এ ছাড়া আফ্রিকার লিবিয়া, মালি থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। যদিও ক্রেমলিনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অনুসারে, প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে প্রিগোজিনের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই।
২০২২ সালের বসন্ত পর্যন্ত ক্রেমলিন এটা বলে আসছে, তাদের সঙ্গে ওয়াগনারের কোনো সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া পুতিন কিংবা তার প্রেস সচিব দিমিত্রি পেসকভ কখনই জোর দিয়ে এটা বলেননি— প্রিগোজিনের বিষয়ে তারা জানেন এবং তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। কিন্তু বাস্তবতা হলো— ক্রেমলিনের অনুমতি ছাড়া এ ধরনের কর্মকাণ্ড ওয়াগনার বা প্রিগোজিনের পক্ষে চালানো সম্ভব ছিল না।
গত বছরের নভেম্বরে প্রিগোজিনকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ওয়াগনার সেন্টার খুলতে দেখা যায়। এ ছাড়া রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করতেও দেখা যায় তাকে। প্রিগোজিনের এই সমালোচনা আরও বাড়ে যখন ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গা থেকে রুশ বাহিনী সরে যায়।
প্রিগোজিন একপর্যায়ে অভিযোগ করেন, ওয়াগনার যোদ্ধাদের অর্জনের স্বীকৃতি দিচ্ছে না রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনী। এর পর সরাসরি রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং রুশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের কড়া সমালোচনা করেন তিনি। প্রিগোজিনের অভিযোগ— গোলাবারুদ সরবরাহ না করার কারণে ইউক্রেনের বাখমুতে ওয়াগনারের হাজার হাজার যোদ্ধা মারা পড়ছেন।
এর পর আরও খ্যাপাটে আচরণ করতে দেখা যায় প্রিগোজিনকে। একটা সময় তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচনা করেন। তাকে দাদা (বৃদ্ধ) বলে সম্বোধন করেন। প্রিগোজিন বলেন, ‘এই যুদ্ধে আমরা কীভাবে জিতব, যদি দাদা বোকা হন।’
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রিগোজিন সরাসরি পুতিনের নাম বলেননি, তবে রাশিয়ার লোকজন এটা ধরে নেন, প্রিগোজিন আসলে পুতিনকে জড়িয়েই এই কথাগুলো বলেছেন।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রিগোজিনের মধ্যে বিরোধ আরও বেড়ে যায়। প্রিগোজিন এই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। একপর্যায়ে রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর অধীন ওয়াগনার গ্রুপকে যুক্ত হতে চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু গত জুনের শেষ দিকে বিদ্রোহ করে বসেন প্রিগোজিন। বিদ্রোহের অংশ হিসেবে মস্কোর উদ্দেশে রওনা দেয় ওয়াগনার বাহিনী।
এ প্রসঙ্গে একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছে, রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যে বিরোধ ছিল, সেই বিষয়ে পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বিদ্রোহ করেছিলেন প্রিগোজিন। কারণ তার ভয় ছিল, রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর অধীন গেলে ওয়াগনারের যে স্বায়ত্তশাসন, তা হারাবেন প্রিগোজিন।
এই বিদ্রোহের মধ্যে ওয়াগনার যোদ্ধারা দুটি সামরিক হেলিকপ্টার, একটি উড়োজাহাজ ভূপাতিত ও ১৫ রুশ সেনাকে হত্যা করেন। এর পর ক্ষেপে যান পুতিন। প্রিগোজিনের নাম উচ্চারণ না করলেও তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যা দেন।
ওয়াগনারের বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। এর পর ৩০ কমান্ডারসহ প্রিগোজিনের সঙ্গে দেখা করেন পুতিন। ক্রেমলিনে তিন ঘণ্টা ধরে তাদের বৈঠক হয়। তবে এই বৈঠকের আগেই ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ইউক্রেনে ওয়াগনার যোদ্ধারা আর যুদ্ধে করবেন না।
ওই বৈঠকের পর প্রিগোজিনের ভাগ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবে প্রিগোজিন বিশ্বাস করতেন, আফ্রিকাই তার ভবিষ্যৎ। এই আফ্রিকা থেকে তাকে একটি ভিডিও প্রকাশ করতে দেখা যায়।
কিন্তু প্রিগোজিন অধ্যায়ের যবনিকা পতন হয়। রাশিয়ার ইতিহাসের অন্যান্য চরিত্রের মতো তারও যাত্রা সাঙ্গ হয়। প্রিগোজিন এক ব্যক্তি, যাকে ক্রেমলিনের নিষ্ঠুরতম নীতিগুলো কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি নিজেই নির্মমভাবে শাস্তি পেয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছেন।
সিটি নিউজ ঢাকার ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন
জেকেএস/