প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৩, ০২:০৭ এএম
প্রায় ছয় বছর আগের কথা। ভারতের রাজস্থানে বিজেপির একটি কর্মী সমাবেশে দলের তখনকার সভাপতি অমিত শাহ (এখন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) খুব গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘সত্যিই হোক বা ফেক, জেনে রাখবেন যে কোনও মেসেজকে আমরা নিমেষে ভাইরাল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।’
শুধু ফাঁকা বুলি নয়; সেটা কীভাবে বিজেপি করে দেখায়, কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের দৃষ্টান্ত দিয়ে সেটাও সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন তিনি। রাজস্থানের বহুল প্রচলিত ‘দৈনিক ভাস্কর’ পত্রিকা অমিত শাহকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিল, ওই রাজ্যে বিজেপি তখন দুটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালাত। একটিতে সদস্য ছিল ১৭ লাখ, অন্যটিতে ১৫ লাখ।
‘এই ৩২ লাখ লোকের কাছে প্রত্যেক দিন সকাল ৮ টায় গুড মর্নিং বার্তার সঙ্গে একটা করে মেসেজ চলে যেত, যেটা তারা আবার নিজেদের পরিচিত মহলে লাখ লাখ লোকের কাছে ফরোয়ার্ড করে দিতেন’, বলেছিলেন অমিত শাহ।
আর ঠিক এভাবেই নির্বাচনী মৌসুমে রাজ্যে রোজকার ‘টকিং পয়েন্ট’ বা ‘ন্যারেটিভ’ কী হবে, সেটা দিনের শুরুতেই স্থির করে দিত বিজেপি। কারণ তাদের পাঠানো বার্তা ততক্ষণে কোটি কোটি ভোটারের কাছে পৌঁছে গেছে এবং তারা সেগুলো নিয়ে তর্কবিতর্কও শুরু করে দিয়েছেন।
অমিত শাহ সেদিন আরও জানিয়েছিলেন, সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব (নিজের বাবা) মুলায়ম সিং যাদবকে থাপ্পড় মেরেছেন, এরকম একটা মেসেজও সেবার কীভাবে ভাইরাল করে তোলা হয়েছিল।
‘অখিলেশ আর মুলায়ম তো তখন ৬০০ মাইল দূরে... কীভাবে চড় মারবেন? মারেননি। কিন্তু আমাদের টিমের কেউ এটা পোস্ট করে দিয়েছে, আর খেয়েও গেছে! সকাল দশটার মধ্যে পুরো রাজ্য জেনে গেছে অখিলেশ নিজের বাবাকেও শ্রদ্ধাভক্তি করেন না!’, বলেছিলেন তিনি।
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) যে শাখাটির এই চমকপ্রদ ‘কৃতিত্বে’র কথা অমিত শাহ সে দিন ফলাও করে বলেছিলেন, সেটিই সারাদেশে ‘আইটি সেল’ নামে পরিচিত। এবং সুনাম আর দুর্নাম, তাদের দুটির পাল্লাই বোধহয় সমান ভারী!
এই বিভাগের পোশাকি নাম অবশ্য ‘ইনফর্মেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট’, জাতীয় স্তরে যার প্রধান এখন অমিত শাহ-রই একজন নেমসেক— তিনি অমিত মালভিয়া।
পেশায় এককালে ছিলেন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। সেসব ছেড়ে এলাহাবাদের ছেলে অমিত মালভিয়া এখন পুরোদস্তুর একজন রাজনীতিক। যে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দলের কাজকর্ম তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে, তিনি তাদেরও অন্যতম।
অমিত মালভিয়া ও তার নেতৃত্বাধীন বিজেপি ‘আইটি সেল’ যে সোশ্যাল মিডিয়াতে রাজনৈতিক প্রচারণাকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে তা নিয়ে ভারতে পর্যবেক্ষকরা সবাই একমত।
অনেকেই অবশ্য একে প্রচার না বলে ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে থাকেন। আইটি সেলের প্রচার প্রায়ই বিশুদ্ধ ‘হেইট স্পিচ’ বলেও ভূরি ভূরি অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ভারতের রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপে এটাই যে সবচেয়ে শক্তিশালী ডিজিটাল হাতিয়ার তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
কীভাবে এক সময় দিল্লির অশোকা রোডের ছোট্ট কামরা থেকে পরিচালিত একটা অপারেশন দিনে দিনে এত প্রভাবশালী হয়ে উঠল, এই প্রতিবেদনে থাকছে তারই সরেজমিন অনুসন্ধান।
দিল্লির সাংবাদিক স্বাতী চতুর্বেদী ২০১৬ সালে একটি বই লিখেছিলেন, যার নাম ‘‘আয়্যাম আ ট্রোল : ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব বিজেপি’স ডিজিটাল আর্মি’’ (আমি একজন ট্রোল : বিজেপির ডিজিটাল বাহিনীর গোপন দুনিয়ার অন্দরমহলে)।
ভারতের শাসক দল বিজেপি কীভাবে দেশময় ছড়িয়ে থাকা তাদের কোটি কোটি সমর্থক ও স্বেচ্ছাসেবীকে অনলাইনে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাবধারা প্রচার করছে এবং তাদের আদর্শিক প্রতিপক্ষদের জীবন ছারখার করে দিচ্ছে, ওই বইতে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছিলেন স্বাতী চতুর্বেদী।
অ্যামাজন ও ফ্লিপকার্টের বেস্টসেলারের তালিকায় ওই বইটি ও তার অনুবাদ এখনও নিয়মিত ওপরের দিকেই থাকে। বইটির মুখবন্ধেই স্বাতী লিখেছিলেন, কীভাবে একটি টুইটার হ্যান্ডল থেকে বিশেষ একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক আছে, ক্রমাগত এই ধরনের নোংরা প্রচার চলতে থাকার পর তিনি খানিকটা বাধ্য হয়েই বই লেখার জন্য এই বিষয়টি বেছে নেন।
‘রাতে আজকাল আমার ‘রেট’ কত যাচ্ছে, কালকে আমার যৌন সম্পর্কগুলো কেমন ছিল, কিছুতেই তৃপ্ত না হয়ে আমি কীভাবে আরও বেশি বেশি করে চাইছিলাম— তখন রোজ সকালে ঘুম ভেঙেই আমার ফোনে এই সব নোটিফিকেশন দেখতে পেতাম’, বইটিতে লিখেছেন তিনি।
তার গবেষণা আরও বলছে, বিজেপি তাদের প্রচারণার জন্য এই অনলাইন ট্রোলকারীদেরকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে, যারা মূলত হিন্দু ডানপন্থী মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তার পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদী।
‘তারা নিজেদের ডিপিতে সাধারণত হিন্দু দেবদেবীর ছবি ব্যবহার করেন। কেউ কেউ আবার বেশি ফলোয়ার টানতে বিকিনি পরা সুন্দরীদের ছবিও দেন। আর তাদের মূল নিশানা হলেন লিবারাল রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিকরা। তিনি নারী হলে তো কথাই নেই!’, লিখেছেন স্বাতী চতুর্বেদী।
গত মাসে হোয়াইট হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের মুসলিমদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করার পর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাবরিনা সিদ্দিকি ছিলেন সেই তালিকায় সবশেষ সংযোজন।
সাবরিনা সিদ্দিকিকে অনলাইনে প্রথম আক্রমণ শানান বিজেপির ‘আইটি সেলে’র বর্তমান প্রধান অমিত মালভিয়া। তারপর তাতে যোগ দেয় শত শত হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র ডানপন্থী হ্যান্ডল। টুইটারে তাদের অনেককে ‘ফলো’ করতেন বা এখনও করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে। আর তারাও নিজেদের টুইটার বায়োতে অবধারিতভাবে লেখেন ‘ব্লেসড টু বি ফলোড বাই পিএম মোদি’!
এই অনলাইন ট্রোলাররা যে বিজেপির তথাকথিত আইটি সেলের প্রত্যক্ষ ‘কর্মী’ তা হয়তো নয়। কিন্তু তৃণমূল স্তরে ছড়িয়ে থাকা এই লাখ লাখ ভলান্টিয়ার বা স্বেচ্ছাসেবীদের সুবাদেই দলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে এত বিপুল ক্ষমতা অর্জন করতে পেরেছে।
দিল্লির দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে বিজেপির নতুন হেডকোয়ার্টারে আইটি সেলের যে জাতীয় অফিস আছে, তাতে যে ঠিক কতজন কর্মী কাজ করেন সে সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
অমিত মালভিয়া বা বিজেপির শীর্ষ নেতারাও কখনো এ বিষয়ে মুখ খোলেন না। বিজেপির অনেক এমপি পর্যন্ত বিবিসির কাছে স্বীকার করেছেন, ঘন ঘন পার্টি অফিসে যাতায়াত থাকলেও আইটি সেলের কর্মকাণ্ড কীভাবে চলে সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই!
দিল্লির সাংবাদিক মানসী কাউর বছর দুয়েক আগে এই আইটি সেলে সরাসরি কর্মরত বা সদ্য ‘চাকরি’ ছেড়েছেন— এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন।
বর্তমানে কানাডা-প্রবাসী কাউর। তিনি বলেন, আমি যতটুকু জেনেছিলাম দিল্লির ওই ‘কোর টিমে’ ২৫ থেকে ৩০ জন কাজ করেন। কিন্তু দিল্লির পাশাপাশি প্রতিটি রাজ্যে, প্রতিটি জেলায় ও পার্লামেন্টোরি কেন্দ্রে, প্রতিটি মিউনিসিপ্যালিটিতে পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত।
‘তাদের কেউ কেউ আইআইটি বা আইআইএমের কৃতী ছাত্র। অনেকে আবার ফিন্যান্স বা কর্পোরেটে মোটা অংকের চাকরি ছেড়ে অনেক কম মাইনেতে দলের কাজে যোগ দিয়েছেন। আবার বিনা মাইনের ভলান্টিয়ারও আছেন, যারা অনেকে অন্য কাজের পাশাপাশি এটা পার্ট-টাইম করেন।’
আইটি সেলে কাজের মাধ্যমেই একদিন সক্রিয় রাজনীতিতে ঢোকার রাস্তা প্রশস্ত হবে— কিংবা দল এমএলএ বা এমপি হওয়ার টিকিট দেবে— এটা তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই মোটিভেশনের কাজ করে।
কাউরের অভিজ্ঞতা বলছে, কিছুদিন পরই ‘মোহভঙ্গ’ হয়ে আইটি সেলের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করেছেন— এমনও অবশ্য বহু দৃষ্টান্ত আছে।
বিজেপির প্রবল সমালোচকরাও একটা কথা মানেন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষমতা যে কত সাঙ্ঘাতিক— ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেটা বিজেপিই প্রথম অনুধাবন করেছিল। বিজেপি তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট খুলেছিল সেই ১৯৯৫ সালে। কংগ্রেস এখানে তাদের চেয়ে দশ বছর পিছিয়ে, তাদের ওয়েবসাইট চালু করতে করতে সেই ২০০৫!
এমনকি, নরেন্দ্র মোদিও তার ব্যক্তিগত হোমপেজ খুলে ফেলেন ২০০৫ সালেই, টুইটারে ঢোকেন ২০০৯ সালে। সেই জায়গায় কংগ্রেসের ‘তরুণ তুর্কী’ রাহুল গান্ধীর ২০১৫ সাল পর্যন্ত টুইটারে কোনও অস্তিত্বই ছিল না।
ডানপন্থী চিন্তাবিদ শুভ্রকমল দত্ত বহু বছর ধরে বিজেপির ঘনিষ্ঠ, তিনি মনে করেন এই দলটি যে এত আগে থেকে ইন্টারনেটকে রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে ব্যবহার করে আসতে পারছে, তার কৃতিত্ব প্রাপ্য দলের প্রয়াত নেতা ও বাজপেয়ী জমানার তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী প্রমোদ মহাজনের।
শুভ্রকমল দত্ত বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মনে আছে অশোকা রোডে বিজেপির পুরোনো দপ্তরে প্রমোদ মহাজনের উদ্যোগেই দলের আইটি উইং খোলা হয়েছিল। ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও সরকারের প্রধান মুখপাত্র হিসেবে হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে তিনি নিয়ম করে একবার সেখানে আসতেন।’
‘কয়েকজন উচ্চশক্ষিত তরুণ ও প্রকৌশলী সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। বিদেশ থেকে বিজেপির বহু সমর্থকও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। টেকনিক্যাল পরামর্শ দিতেন প্রফেশনালরাও।’
‘ফেসবুক-ইনস্টা বা হোয়াটসঅ্যাপ তখন ওসব কিছুই আসেনি। অর্কুট নামে একটি প্ল্যাটফর্ম ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল, আর ছিল ইয়াহু ও এমএসএন মেসেঞ্জার। বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় তাদের যাত্রা শুরু করেছিল এগুলোর হাত ধরেই’, জানান শুভ্রকমল দত্ত।
২০০৪ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীকে আবার জেতাতে ডিজিটাল মাধ্যমে যে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ ক্যাম্পেইন শুরু হয়, তারও মূল কারিগর ছিলেন প্রমোদ মহাজন (ও তার আইটি শাখা)।
কিন্তু ভোটে বাজপেয়ীর অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর সেই ক্যাম্পেইন মুখ থুবড়ে পড়ে, ভাঁটা পড়ে বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া তৎপরতাও। এরই মধ্যে ২০০৬ সালের মে মাসে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে প্রমোদ মহাজন নিজের বড় ভাইয়ের হাতে খুন হন।
তবে শুভ্রকমল দত্ত বিশ্বাস করেন, ‘ইন্টারনেটই যে রাজনৈতিক প্রচারের ভবিষ্যৎ, এটা বিজেপি ঠিক সময়ে বুঝেছিল এবং সেই অনুযায়ী তাতে প্রচুর শ্রম ও সম্পদ লগ্নি করেছিল বলেই পরে তারা সেটা থেকে এত ডিভিডেন্ড পেয়েছে।’
স্বাতী চতুর্বেদী তার বইতে একটা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, মোটামুটি ২০১২ সাল থেকে অনলাইন ও ডিজিটাল মাধ্যমে ধারাবাহিক প্রচার চালিয়ে কংগ্রেস নেতা ও নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জার রাহুল গান্ধীকে বিজেপি কীভাবে ‘পাপ্পু’ বানিয়ে তুলেছিল।
‘পাপ্পু’ বলতে হিন্দিতে অপদার্থ ও নিষ্কর্মা লোককে বোঝায়। আর বিজেপির প্রচারে মানুষ এটা সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, রাহুল গান্ধী মোটেও কোনও সিরিয়াস রাজনীতিবিদ নন।
আর এটা সম্ভব হয়েছিল বিজেপির পুরোনো আইটি সেলের সুবাদেই। তখন সোশ্যাল মিডিয়াতে অস্তিত্বহীন কংগ্রেসের কাছে এর কোনও জবাবই ছিল না।
বিজেপির সোশ্যাল মিডিয়া অভিযান আবার নতুন করে শুরু হয় ২০১০ সাল নাগাদ। তবে এবারে তার ভরকেন্দ্র ছিল গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগর; দিল্লিতে নয়।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন থেকেই ধীরে ধীরে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। আর তার প্রচার মেশিনারিকে ডিজিটালি ঢেলে সাজাতেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল অরবিন্দ গুপ্তা নামে এক তরুণ প্রযুক্তিবিদকে।
দিল্লির ছেলে অরবিন্দ গুপ্তা আইআইটি থেকে ইলেকট্রনিকসে স্নাতক। পরে আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, আর্বানা-শ্যাম্পেন থেকে তিনি এমবিএ আর কম্পিউটার সায়েন্সে এমএসও করেছেন।
এর আগে দুটি স্টার্ট-আপে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই সম্ভবত অরবিন্দ গুপ্তা বিজেপির আইটি সেলকেও ঠিক স্টার্ট-আপের ধাঁচেই চালাতে শুরু করেন। পার্টি অফিসগুলোতে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের ব্যবস্থাও শুরু করেন তিনি, যাতে নেতারা অফিসে বসেই একসঙ্গে অনেকের সঙ্গে বৈঠক সেরে ফেলতে পারেন।
বড় বড় নেতাদের জনসভাগুলো ইউটিউব বা ফেসবুকের মতো ডিজিটাল মাধ্যমে লাইভ সম্প্রচারেরও ব্যবস্থা করা হয়। অনলাইনে মাত্র ৫ রুপি দিয়ে বিজেপির সদস্য তৈরি করার ভাবনাও ছিল তারই মস্তিষ্কপ্রসূত। ২০১০ সালে এই পদ্ধতি চালু হওয়ার মাত্র দুই বছরের মধ্যে বিজেপি এভাবে অতিরিক্ত পাঁচ লাখ সদস্য সংগ্রহ করে ফেলে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা (২৭২ টিরও বেশি আসন) পাওয়ার অন্যতম নেপথ্য কারিগর ছিলেন অরবিন্দ গুপ্তা। বিজেপির ঘনিষ্ঠরা অনেকেই সে কথা মানেন। পরে অবশ্য তিনি আইটি সেল থেকে সরে দাঁড়ান।
তার কয়েক বছর পর একটি প্রকাশ্য সভাতেই গুপ্তা ব্যাখ্যা করেছিলেন, ঠিক কোন তিনটি মূল স্ট্র্যাটেজির ওপর ভরসা করে সেবার বিজেপির ডিজিটাল ক্যাম্পেইনকে পরিচালনা করা হয়েছিল। এই কৌশলগুলো ছিল :
• সবার আগে একটি সলিড টেকনিক্যাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেটা এই ওয়ার্কলোড নিতে পারবে এবং টিকবে।
• সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ‘বিলিভার’ (সমর্থক) ও ‘ভলান্টিয়ারদের’ (স্বেচ্ছাসেবী) এক বিপুল বাহিনী তৈরি করা, যাদের ঐক্যবদ্ধ করে ‘স্লোগান ২৭২ প্লাসের পক্ষে কাজে উদ্বুদ্ধ করা যাবে।
• তারপর অনলাইন পেশাদার, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর এবং তৃণমূল স্তরে ৪০০টি সংসদীয় কেন্দ্রে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ২২ লাখ ভলান্টিয়ারকে নিয়ে একটি সর্বাত্মক ‘থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি ক্যাম্পেইন’ চালানো, যেখানে তারা নিজেদেরই ‘টুল’ ব্যবহার করবেন এবং বিজেপির হয়ে ‘ফ্রি কনটেন্ট’ তৈরি করে যাবেন।
সেই সফল ক্যাম্পেইনের প্রায় এক দশক পরে বিজেপির আইটি সেল আজও মোটামুটিভাবে পরীক্ষিত মডেলটাই অনুসরণ করে যাচ্ছে— শুধু আকারে ও আয়তনে তা আরও বহুগুণে বেড়েছে।
বিজেপির আইটি সেলকে দেশটির বিরোধী দলগুলো যতই গালমন্দ করুক, তাদের কাজের ধারাটাই (কনটেন্ট নয় অবশ্যই) যে অন্য দলগুলোকে আজ চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করতে হয়েছে এটা বিরোধী নেতারাও একান্ত আলোচনায় স্বীকার করেন।
সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালানো বা অনলাইনে ডোনেশন সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বিজেপি ছাড়া ভারতের আর একটি দলও বেশ সফল— সেটি হল মাত্র দশ-বারো বছরের পুরোনো আম আদমি পার্টি (এএপি)।
আম আদমি পার্টির সোশ্যাল মিডিয়া শাখার প্রধান অঙ্কিত লালও নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছেন, ডিজিটাল ক্যাম্পেইনে বিজেপিই কিন্তু আমাদের পথ দেখিয়েছে। তবে কনটেন্টটাই হল আসল জিনিস— যে কারণে দিল্লি বা পাঞ্জাবে আমরা তাদের চালেই তাদের কিস্তিমাত করেছি।
কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র পবন খেড়া আবার দাবি করছেন, সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক আগে অভিযান শুরু করে বিজেপি হয়তো কিছুটা ‘আর্লি স্টার্টার অ্যাডভান্টেজ’ পেয়েছে। কিন্তু ক্রেডিবিলিটি বা বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে কংগ্রেস এখন তাদের অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে।
খেড়া বিবিসিকে বলছিলেন, ভারতের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও হয়তো বিজেপির আইটি সেলের আওয়াজে গলা মেলাতে কিছুটা বাধ্য হয়। কিন্তু আপনি যে কোনও সম্পাদকের সঙ্গে অফ দ্য রেকর্ড কথা বললেই দেখবেন তারা নিজেরা কেউ সে কথাগুলো বিশ্বাস করেন না।
‘আসলে কংগ্রেস পরে শুরু করলেও বিশ্বাসযোগ্যতার নিরিখে এখন অনেক এগিয়ে গেছে। ন্যারেটিভ তৈরির মেশিনারি হিসেবে কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া টুলগুলো যে কত বেশি গ্রহণযোগ্য, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রার সময়েই সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে।’
বিরোধীদের আরও একটা বড় অভিযোগ হল, সরকারে থাকার সুযোগ নিয়ে বিজেপি টুইটার, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের চাপ দিয়ে তাদের অপছন্দের কনটেন্টে বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে যথেচ্ছভাবে।
টুইটারের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সিইও জ্যাক ডর্সি তার সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে কোনও রাখঢাক না করেই বলেছেন, ভারত সরকারের কাছ থেকে কীভাবে তাদের চাপের মুখে পড়তে হতো, বলছিলেন কংগ্রেস নেতা পবন খেড়া।
ভারতে কোটি কোটি মানুষের বাজার উপেক্ষা করা এই টেক জায়ান্টদের পক্ষে কার্যত সম্ভব নয় বলেই তারা কিছুটা আপসের রাস্তায় যাচ্ছে এবং বিজেপি ও তাদের আইটি সেল তার সুযোগ নিচ্ছে পুরো মাত্রায়— এই পর্যবেক্ষণে কংগ্রেস, তৃণমূল বা আপের মতো সব বিরোধী দলই কিন্তু এক সুর!
ভারতে বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের অনেকেই আবার মনে করেন, বিজেপির আইটি সেলের তথাকথিত সাফল্য আসলে অনেকটাই ‘বট-ড্রিভেন ও রিসোর্স-ড্রিভেন অপারেশন’।
অর্থাৎ কি না, বিজেপির হয়ে যে লাখ লাখ টুইট বা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট রোজ অনলাইন দুনিয়াকে ভাসিয়ে দিচ্ছে সেটা অনেকটাই কৃত্রিম ও যান্ত্রিক ‘বট’ দিয়ে তৈরি করা। অত মানুষের সংশ্লিষ্টতা বা ‘অর্গানিক ইনভলভমেন্ট’ সেখানে আদৌ নেই।
আসলে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা অনেকেই যে না দেখে যান্ত্রিকভাবে তাদের হ্যান্ডল থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘ফিড’ করা একটা বার্তা রোজ পোস্ট করে থাকেন, এটা ফাঁস হয়ে গিয়েছিল ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একটা ঘটনায়।
সেদিন সকালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পন রাধা কৃষ্ণনের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য কাজ করাটা মোদি সরকারের অগ্রাধিকারের একেবারে তলার দিকে!’ এবং এরকম আরও কিছু চমকে দেওয়ার মতো সরকার-বিরোধী বক্তব্য!
হুবহু একই ভাষায় সেদিন একই জিনিস টুইট করে বিজেপির আসাম শাখা এবং আরও কেউ কেউ। ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা পরে টুইট করে দেখান, বিজেপির আইটি সেল আসলে রোজ একটি গুগল ডকস ডকুমেন্ট তৈরি করে, যেটি থেকে নেতা-মন্ত্রীদের হ্যান্ডলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট হয়ে যায়!
‘এখন আপনি যদি কোনোভাবে ওই ডকুমেন্ট এডিট করে ফেলতে পারেন, তাহলে কিন্তু বিজেপি নেতাদের দিয়ে আপনি আপনার খুশি মতো যা খুশি টুইট করিয়ে ফেলতে পারবেন’, বলেন সিনহা।
তবে তিনি বা তার টিম সেই ডকুমেন্ট এডিট করেই পন রাধা কৃষ্ণন বা আসাম বিজেপির অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাক’ করেছিলেন কি না, তিনি সেটা ভাঙেননি। সেই ঘটনার প্রায় সাড়ে চার বছর পরে সিনহা বিবিসিকে বলছিলেন, আইটি সেলের মোডাস অপারেন্ডি বা কাজ করার ধরনটা আজও প্রায় একই রকম আছে বলেই আমাদের পর্যবেক্ষণ।
তবে হ্যাঁ, সিকিওরিটি অ্যাসপেক্টটা অনেক বাড়ানো হয়েছে, ফলে সেটা হ্যাক করা এখন অনেক কঠিন, বলছিলেন তিনি।
আসলে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহারের যাবতীয় টেকনিক্যাল কৌশল, পেশাদারদের যোগদান, লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবীর সক্রিয়তা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং একটা মতাদর্শগত ন্যারেটিভের সফল বিপণন— এসব উপাদানই বিজেপির আইটি সেলকে এত প্রভাবশালী ও সেই সঙ্গে এত বিতর্কিত করে তুলেছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সাবেক সিনিয়র সাংবাদিক পামেলা ফিলিপোজ খানিকটা রসিকতা করেই বলছিলেন, আমি এর অনেকটা কৃতিত্ব দেব অমিত মালভিয়াকে— কারণ এককালে ফিন্যান্স সেক্টরে কাজ করার সুবাদে তিনি কোম্পানির ‘মার্জার’ (সংযুক্তি) ও ‘অ্যাকুইজিশনে’র (অধিগ্রহণ) গুরুত্বটা খুবই ভালো বোঝেন।
‘আইটি সেলেও তিনি কিন্তু ঠিক একই কাজ করছেন... শুধু মার্জার করছেন অর্ধ-সত্য আর অর্ধ-মিথ্যার আর অ্যাকুইজিশন চলছে ফলোয়ার আর মিডিয়া ক্লায়েন্টদের!’ বিবিসি বাংলা।
বিএস/