• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

নয় বছরে যে ৯ উপায়ে বদলে গেছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২৩, ০৯:০৩ পিএম

নয় বছরে যে ৯ উপায়ে বদলে গেছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত দিক নির্দেশনামূলক। যার মাধ্যমে একটি দেশ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজের প্রভাব বাড়িয়ে থাকে। ভারতও বিগত ৯ বছরে বিশ্ব পরিমণ্ডলে নিজের প্রভাব বাড়িয়েছে। হয়ে উঠেছে এক গুরুত্বপূর্ণ উঠেছে। এনডিটিভিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ভারত বিগত ৯ বছরে যে ৯টি উপায়ে বিশ্ব পরিমণ্ডলে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোসেফ নাই তার বই ‘সফট পাওয়ার: দ্য মিনস টু সাকসেস ইন ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স’ শীর্ষক বইতে উল্লেখ করেছেন, বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি দেশের প্রভাব কেবল সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং পররাষ্ট্রনীতির ওপর নির্ভর করেও প্রতিষ্ঠিত হয়। জোসেফ নাইয়ের মতে, পররাষ্ট্রনীতিতে দৃঢ়তা আগ্রাসনের সমতুল্য নয় বরং এটি হার্ড পাওয়ারের পাশাপাশি সফট পাওয়ারের কৌশলী ব্যবহারের সঙ্গে জড়িত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিগত নয় বছরে ঠিক এই অবস্থানই স্পষ্টভাবে গ্রহণ করেছেন। তার শাসনামলেই ভারত বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে হাজির হয়েছে। মোটা দাগে যে ৯টি কারণে ভারত পররাষ্ট্রনীতির দিল্লিকে বিশ্বমঞ্চে অনন্য আসন দিয়েছে তা নিচে আলোচনা করা হলো।  

১. বাস্তববাদ: ২১শতকের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে। একটা সময় ছিল, যখন ভারত শক্তভাবে জোট নিরপেক্ষ অবস্থানকে আঁকড়ে ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বিশ্ব বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে ভারত তার অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থকে সামনে রেখে আরও বাস্তববাদী অবস্থান নিতে উদ্যোগী হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত তার স্বাধীন অবস্থান নিশ্চিত করেছে এবং বহিরাগত চাপের মুখে মাথা নত করতে অস্বীকার করেছে।

এর উদাহরণ হতে পারে ইউক্রেন সংকট, চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ এবং কোয়াড জোটে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নয়া দিল্লির অবস্থান। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে নিজ স্বার্থে ক্রুড জ্বালানি কিনছে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
 
২. অভ্যন্তরীণ সংকট কাটিয়ে উঠা: কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স সরকারের সময় ভারতের পররাষ্ট্রনীতি অভ্যন্তরীণ কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যেমন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি হওয়ার পরও তামিলদের দাবির কাছে মাথানত করে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলন বয়কট করেছিল ভারত। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদও স্বীকার করেছেন যে, ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে পররাষ্ট্রনীতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।


এর ফল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো কখনোই মসৃণ ছিল না বরং এক ধরনের অস্থিরতা বা উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে গেছে। যেমন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তৎকালীন ভারত সরকারের দুর্বল সম্পর্ক নিকট প্রতিবেশী চীনকে সুবিধা দিয়েছে। সবমিলিয়ে তৎকালীন জোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ভারতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অ্যাক্টর বা প্রভাবক হয়ে উঠতে দেয়নি। কিন্তু বিগত নয় বছরে ভারত আগের অবস্থান পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সংকট আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে না।  

৩. গ্লোবাল সাউথের মুখপাত্র হয়ে উঠা: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্লোবাল সাউথের উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে কথা বলার অন্যতম বড় মুখপাত্রে হিসেবে হাজির হয়েছে ভারত। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং ক্রমাগত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণেই ভারত এই অবস্থান অর্জন করতে পেরেছে।

ব্রিকস, জি-২০ এর মতো জোট, জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন ইত্যাদি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ভারতের ভূমিকা গ্লোবাল সাউথের মুখপাত্র হিসেবে দেশটির অবস্থান নিশ্চিত করে।
 
৪. উন্নয়ন অংশীদারত্ব: ভারত নিজেকে একটি বিশ্বাসযোগ্য উন্নয়ন অংশীদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে। ভারতের উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে আইটি কেন্দ্র স্থাপন, ফেরি সরবরাহ, ট্রেন সরবরাহ, বিভিন্ন কারখানা পুনরুজ্জীবিত করা এবং গণপরিবহন খাতের সমস্যা সমাধান করা।

৫. অর্থনৈতিক সহযোগিতা: ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে অন্যতম সহযোগী বলে বিবেচিত। এর ফলে, দেশটিতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে, রপ্তানি আরও বেড়েছে এবং হাইটেক শিল্পখাত যেমন সেমিকন্ডাক্টরের মতো শিল্পও বিকশিত হয়েছে।  

ব্রিকস জোট ভারতের বেড়ে ওঠার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। একই মঞ্চে ব্রিকস জোটের নেতারা।
৬. বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের অবদান রাখা: স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো বৈশ্বিক সমস্যাগুলোতে ভারত নিজেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভ্যাকসিন মৈত্রী উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সৌর জোট এবং দুর্যোগ প্রতিরোধী অবকাঠামোর জোটে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারত। এছাড়া কোয়াড, সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজেশন এবং রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানে ভারতের প্রবেশ, বৈশ্বিক ফোরামে এর ক্রমবর্ধমান অংশীদারত্ব ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বদলে যাওয়াকেই প্রতিফলিত করে।  

৭. আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ন্যারেটিভ পুনর্গঠন: ভারত জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক এবং কোয়াডের মতো বৈশ্বিক কৌশলগত ধারণার মতো বিষয়গুলোতে বৈশ্বিক ন্যারেটিভ গঠনে অংশগ্রহণ করেছে। এর মাধ্যমে ভারত নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে এবং ন্যারেটিভ গঠনে সফল হয়েছে। অন্যদের দ্বারা সংগঠিত বৈশ্বিক ন্যারেটিভে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে ভারত সক্রিয়ভাবে তার নিজস্ব ন্যারেটিভ তৈরি করছে।

৮. দেশের বাইরেও ভারতীয়দের সুরক্ষা দেয়া: ভারত বিদেশে তার নাগরিকদের সুরক্ষার প্রতি দৃঢ় অবস্থান দেখিয়েছে। বিশেষ করে সংকটের সময়। দেশটি বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাত বা কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিদেশে আটকে থাকা ভারতীয়দের নিরাপত্তা এবং প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে সবসময়ই কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।  
 
৯. নতুন সুযোগ সৃষ্টি: ভারতীয় কূটনীতি বেশ কয়েকটি দেশের সাথে গতিশীল চুক্তি স্থাপনে সফল হয়েছে। যার ফলে বিদেশে ভারতীয় কর্মী এবং পেশাদারদের জন্য সুযোগ বাড়িয়েছে। নাগরিককল্যাণ ব্যবস্থার উন্নতি, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ভারতীয় শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি মূলত সফল কূটনৈতিক আলোচনার ফল।  

ভারত আঞ্চলিক এবং বিদেশী বাণিজ্য চুক্তির দিকে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করছে। এই পরিবর্তন টের পাওয়া যায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর সঙ্গে বেশ কয়েকটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) থেকে। এই পরিবর্তন ভারতের কৌশলগত দূরদর্শিতা এবং বিশ্ব বাণিজ্যের গতিশীলতাকে নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করার আগ্রহের প্রমাণ। ভারত বাণিজ্যকে কেবল নিছক লেনদেনের বিনিময় হিসেবে দেখে না বরং দেশটি এসব চুক্তির বিষয়ে আরও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। এই চুক্তিগুলো ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা, কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত করা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উত্সাহিত করতে চায় ভারত।  

আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত তার অর্থনৈতিক দক্ষতা, ভূ-কৌশলগত অবস্থান এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে নিজের মূল স্বার্থ এবং মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে অন্যান্য দেশের সাথে তার সম্পর্ক গঠন করছে। এই দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি সীমান্ত বিরোধের সমাধান, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং কৌশলগত মৈত্রী বৃদ্ধির মাধ্যমে টের পাওয়া যায়। এই বাস্তবসম্মত অথচ দৃঢ় পররাষ্ট্রনীতি ভারতের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি রাখে এবং দেশটিকে বিশ্ব রাজনীতির জটিল দাবার বোর্ডে একটি প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।


এডিএস/

আন্তর্জাতিক সম্পর্কিত আরও

আর্কাইভ