প্রকাশিত: মে ৫, ২০২৩, ০৩:৪১ এএম
সৌদি আরব থেকে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন যুদ্ধকবলিত সুদান থেকে উদ্ধার হওয়া ইরানিরা। বিমানে যার যার আসনে বসে আছেন সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই রানওয়ে থেকে উড়াল দেবে আকাশযানটি। তখনই সেখানে হাজির সৌদি আরবের এক শীর্ষ কমান্ডার। বিমানে থাকা ইরানিদের উষ্ণ বিদায় জানালেন তিনি। শোনালেন ভ্রাতৃত্বের কথা।
ঘটনাটি ঘটেছে গেল নিবার (২৯ এপ্রিল) জেদ্দায়। সৌদি পশ্চিমাঞ্চলীয় আঞ্চলিক কমান্ডার মেজর জেনারেল আহমেদ আল-দাবাইসের সঙ্গে ছিলেন সৌদিতে ইরানি উপরাষ্ট্রদূত হাসান জারাঙ্গার।
বিমানযাত্রীদের আহমাদ আল-দাবাইস বলেন, ‘এটা এখন আপনাদের দেশ। যদি সৌদিতে কিছু প্রয়োজন পড়ে, আপনাদের স্বাগত। কোনো শঙ্কা নেই। সৌদি আর ইরান হলো ভাই ভাই।
এর আগে সুদান থেকে ৬৫ ইরানিকে উদ্ধার করা হয়েছিল। লোহিত সাগরের শহর জেদ্দায় ফুলের তোড়া দিয়ে তাদের স্বাগত ও অভ্যর্থনা জানিয়েছে সৌদি সামরিক বাহিনী। সৌদি ও ইরানি সম্প্রচারমাধ্যমগুলোতে যা সরাসরি প্রচার করা হয়েছে।
বিমানে আহমেদ আল-দাবাইস যখন কথা বলছিলেন, তখন বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে তিনি হাসান জারাঙ্গার হাত ধরে রেখেছিলেন। দাবাইস বলেন, ইরানি উদ্বাস্তুদের সসম্মানে আশ্রয় দিতে নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল-সৌদ ও সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমান।
সেদিন ইরানিদের প্রতি সৌদিরা যে উষ্ণতা ও আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, মাস কয়েক আগেও তা ছিল অকল্পনীয়। তারা ছিল তখন পরস্পরের শত্রু দেশ। আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে দুদেশের মধ্যকার তিক্ততা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে তারা মধ্যপ্রাচ্যে কয়েকটি ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যাতে ব্যাপক প্রাণহানি, রক্তক্ষয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে। কিন্তু সাত বছরের বৈরি সম্পর্ক চীনের মধ্যস্থতায় মিটিয়ে ফেলেছে তারা।
আল-জাজিরার খবর বলছে, অল্প সময়ের মধ্যেই পরস্পরের রাজধানীতে দূতাবাস খুলবে সৌদি আরব। যদিও এখনও দূতাবাস খোলার সুনির্দিষ্ট তারিখ পাওয়া যায়নি।
২০১৫ সালে হুতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত যুক্ত হওয়ার পর থেকে সৌদি, ইরান সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। পরের বছর দুই দেশের রাজধানী থেকে তারা দূতাবাস গুটিয়ে নিয়েছিল। এরপর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি সংঘাতে সৌদি ও ইরান একে অপরের বিরুদ্ধে অংশ নেয়।
সৌদি বিশ্লেষক ও লেখক আলী শিহাবি বলেন, বিমানে সৌদি কমান্ডারের এই শুভেচ্ছাবার্তা ইরানিদের জন্য আশাজাগানিয়া। তাদের কাছ থেকেও এর প্রতিফলন দেখা যাবে। এতে দুই দেশের জনগণের মধ্যেও সম্পর্ক বৃদ্ধি ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
সবকিছু মিলিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে সৌদি আরব। দেশটি তার বৈশ্বিক ভাবমর্যাদা নতুন করে গড়তে চায়। সাবেক শত্রুদের সঙ্গে একে একে ঝগড়া মিটিয়ে নিচ্ছে রিয়াদ।
কেবল দ্বন্দ্বের অবসানই না, শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখতে চায় সৌদি আরব। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক চেষ্টার মধ্য দিয়ে সেই সংকল্পের কথা জানিয়েছে দেশটি। গেল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সৌদি পররাষ্ট্রনীতি ছিল দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময়। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদির পরিচয় ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ হিসেবে। এ সময়ে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতেও দেখা গেছে রিয়াদকে।
ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক আন্না জ্যাকভ বলেন, সৌদির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে নতুন এক পররাষ্ট্রনীতির দেখা মিলছে। তারা নতুন চেহারা নিয়ে হাজির হতে চায়। আগের চেয়ে ভিন্ন ভূমিকা রাখতে চায়।
তিনি জানান, এজন্য তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে চাচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটি। রিয়াদের নতুন পররাষ্ট্রনীতি অনেক বেশি স্বাধীন এবং নিজেদের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
সুদানে কূটনৈতিক তৎপরতা
উত্তরপূর্ব আফ্রিকার দেশ সুদানে দুই জেনারেলের অনুগত বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। সুদানিজ সশস্ত্র বাহিনীর (এসএএফ) কমান্ডার আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ও দ্য র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) প্রধান মোহাম্মদ হামদান দাগালোর মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকেই এই সংঘাত। দুই জেনারেলই দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। আরএসএফের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক রয়েছে।
এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষ হতাহত হয়েছেন। বহু মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়েছে। সংঘাতকবলিত এই দেশটিতে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। সংঘাতে অংশগ্রহণকারী হলেও তারা এখন শান্তিপ্রতিষ্ঠাকারী হতে চাচ্ছে।
সৌদি সংবাদমাধ্যমগুলোতে সম্প্রচার হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বন্দর সুদান থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে উদ্ধার করে উপকূলীয় শহর জেদ্দায় নিয়ে যাচ্ছে সৌদি সামরিক বাহিনী। সুদান থেকে জেদ্দা শহরে পৌঁছাতে লোহিত সাগরে অন্তত ১২ ঘণ্টার নৌযাত্রার করতে হচ্ছে।
ভিডিওতে দেখা গেছে, দীর্ঘ সাগরযাত্রা শেষে উদ্বাস্তুরা জেদ্দা বন্দরে পৌঁছালে তাদের হাতে সৌদি পতাকা দেয়া হচ্ছে। পতাকা দুলিয়ে দুলিয়ে তারা বন্দর থেকে স্থলে যাচ্ছেন।
সোমবার (১ মে) সৌদি সরকার জানিয়েছে, এ পর্যন্ত তারা শতাধিক দেশের হাজার পাঁচেক লোককে উদ্ধার করেছে। নিরাপদেই তাদের সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে তারা নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি দূতাবাসের মুখপাত্র ফাহাদ নাজর বলেন, ‘সংকট কাটিয়ে উঠতে যা যা করা দরকার, আমরা তার সবই করছি। আমরা সেই চেষ্টার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র ও আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গেও নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গত সপ্তাহে সুদানের এসএসএফ কমান্ডার আল-বুরহান ও আরএসএফের দাগালোর মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরত চুক্তির মধ্যস্থতা করেছে সৌদি আরব। সোমবার থেকে ৭২ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল চুক্তিটি। দুই কমান্ডারকে সমঝোতায় নিয়ে আসতে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সৌদি আরব।
বিশ্লেষক আলী শিহাবি বলেন, সুদানে তৎপরতার মধ্য দিয়ে লোহিত সাগর ঘিরে সৌদি আরবের যে সুযোগ রয়েছে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তা কাজে লাগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য পথ করে দিচ্ছে রিয়াদ। এতে বিশ্বে সৌদি আরবের ভাবমর্যাদা বেড়ে যাবে। এখন থেকে সৌদিকে ভিন্নভাবে চিনতে পারবে বিশ্ববাসী।
সৌদি আরবকে এমন এক সময়ে নতুন কূটনৈতিক তৎপরতায় দেখা যাচ্ছে যখন দেশটি নিজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এ ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে না রিয়াদ। অর্থাৎ সৌদি যদি অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধি অর্জন করতে চায়, তাহলে অবশ্যই আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। না হলে সমৃদ্ধি অর্জনের পথ মসৃণ থাকবে না।
সৌদি আরব এখন এক লাখ কোটি মার্কিন ডলার অর্থনীতির দেশ। রক্ষণশীল, যুদ্ধপ্রিয় ও তেল উৎপাদনের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি আরবের যে পরিচিতি রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে তারা। আরব উপদ্বীপের দেশটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক খেলোয়াড় ও আঞ্চলিক পর্যটন এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রবিন্দু হতে চাচ্ছে। যে কারণে খোলস পাল্টে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় মরিয়া মোহাম্মদ বিন সালমান।
আন্না জ্যাকব বলেন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সৌদির হস্তক্ষেপের নীতি দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা টেনে আনছিল। শত্রু বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রমাগত নিরাপত্তা হুমকিতে ভুগছিল সৌদি সরকার। এসব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে সৌদি।
দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তেলস্থাপনা ও বিমানবন্দরগুলো বারবার হামলার শিকার হচ্ছিল। অধিকাংশ হামলারই দায় স্বীকার করেছে পার্শ্ববর্তী দেশের হুতিরা। এরপর কেবল ইরানই না, হুতিদের সঙ্গেও দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিতে তৎপর হয়েছে সৌদি সরকার।
পাশাপাশি তুরস্ক ও সিরীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পথে হাঁটছে রিয়াদ। বৈশ্বিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়া সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদকে সুযোগ করে দিচ্ছে আরব বিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার। এক দশক আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আসাদ সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল সৌদিসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
এদিকে গেল সপ্তাহে মক্কায় ওমরাহ পালন করতে দেখা গেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের একদল নেতাকে। দুই বছর পরে জেদ্দা শহরে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেছেন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। গত এক দশক ধরে হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এ ছাড়া গত দশকে সৌদি আরবের সঙ্গেও হামাসের সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল।
বিশ্বাসযোগ্যতার চ্যালেঞ্চ
সৌদি আরবের মধ্যস্থতার চেষ্টা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গত বছর সৌদি আরব বলেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দিবিনিময়ে ভূমিকা রেখেছে তারা। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই সেনা ও পাঁচ ব্রিটিশ নাগরিকসহ অন্তত ১০ জন মুক্তি পেয়েছেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে সৌদি আরব জানিয়েছে, রাশিয়ার কারাগার থেকে মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ব্রিটন্নি গ্রিনারকে মুক্তির বিষয়ে তারা মধ্যস্থতা করেছেন। বিনিময়ে রাশিয়ার অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিক্তর বাউটকে মুক্তি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে এভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে শান্তির বাহক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাচ্ছে সৌদিরা। মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যার দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই মোহাম্মদ বিন সালমানের। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে এ নিয়ে তার ওপর চাপ রয়েছে।
এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সৌদি আরব যে ভূমিকা রেখে যেতে চাচ্ছে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গেল দশকে সৌদির পররাষ্ট্রনীতি ছিল যুদ্ধংদেহী। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সৌদি আরবকে নিয়ে ভালো কোনো খবর প্রকাশ হওয়ার ঘটনা ছিল বিরল।
গত মাসে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় সৌদি আরব ও হুতি গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি আলোচনা হয়েছে। সেখানে হুতি নেতারা দাবি করেছেন, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরব কোনো মধ্যস্থতাকারী ছিল না, বরং তারা সরাসরি এতে অংশ নিয়েছিল। সৌদি বিমান হামলায় ইয়েমেনের নিষ্পাপ নারী ও শিশুরা হত্যার শিকার হয়েছে। সেই রক্তের দাগ এখনও মুছে যায়নি।
জেকেএস/