প্রকাশিত: মে ১, ২০২৩, ০২:৩১ এএম
লন্ডন ও ওয়াশিংটন-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা গ্লোবাল উইটনেসের ফাঁস হওয়া গোপন নথিতে বলা হয়েছে, সুদানের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) গডফাদার হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। ২ হাজার ৭৫৪ কিলোমিটার দূরে বসে সুদানে ক্ষমতা দখল দ্বন্দ্বের কলকাঠি নাড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের এই ধনকুবের দেশ। আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালোর (হেমেদতি) এর সঙ্গে জড়িত।
আরব আমিরাত ও তার অজ্ঞাবহ হেমেদতির মোটা অঙ্কের লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে নথিতে।
যুদ্ধ-দারিদ্র্য-দুর্নীতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ নিয়ে কাজ করা এনজিওটির হাতে পড়া তথ্যে দেখা গেছে, সোনার খনির দেশ সুদানের স্বর্ণশিল্পের একটি বিরাট অংশই হেমেদতির দখলে। কিছু ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই স্বর্ণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন হেমেদতি।
ফাঁস হওয়া নথিতে আরও দেখা যায়, সুদান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত-ভিত্তিক ফ্রন্ট কোম্পানি এবং ব্যাংকগুলোতেও লেনদেন রয়েছে আরএসএফের। ন্যাশনাল ব্যাংক অব আবুধাবিতে (বর্তমানে প্রথম আবুধাবি ব্যাংকের অংশ) আরএসএফের নামে একটি অ্যাকাউন্টও রয়েছে।
হেমেদতির নিজস্ব সম্পদ বৃদ্ধির উৎস সংযুক্ত আরব আমিরাত। এছাড়া এই নথিতে দেখা যায়, মিলিশিয়া বাহিনীটি একটি অজানা উৎস থেকে ‘প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য’ ৪০ মিলিয়নেরও বেশি সহায়তা পেয়েছিল। আর এর ৩০ মিলিয়নেরও বেশি যানবাহন এবং যোগাযোগ সরঞ্জাম কেনার জন্য ব্যবহার করেছে।
নথি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ১,০০০টিরও বেশি যানবাহন কিনেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিলারদের থেকে। চালানের মধ্যে ৯০০টিরও বেশি টয়োটা হিলাক্স এবং ল্যান্ড ক্রুজার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গত মঙ্গলবার দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। থার্মোবারিক শেলের ফুটেজ তা স্পষ্ট হয়। ফুটেজে দেখা য়ায়, ১২০ মিমি থার্মোবারিক এয়ারড্রপ শেল, যা ২০২০ সালে সার্বিয়ায় তৈরি। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সরবরাহ করা হয়েছিল।
টেলিগ্রাফকে বিশ্লেষকরা জানান, ভিডিওটি নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুন্ন করে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা সুদানের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান সালাহ গোশকে দায়ী করে একটি রেকর্ডিং প্রচার করেছে। যেখানে সুদানের চলমান বিশৃঙ্খলার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অভিযুক্ত করা হয়।
হেমেদতির নেতৃত্বে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) সেনাবাহিনীকে প্রতিস্থাপন করার লক্ষ্যে তারা আরব আমিরাতের আবুধাবিতে একটি ‘কমান্ড সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। যদিও অডিও রেকর্ডটি যাচাই করা যায়নি। অডিও পর্যালোচনা করে সুদানের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ কামাল আবদেল মারুফ বলেন, সুদানে প্রাথমিক পরিবর্তন শুরু হয়েছিল একটি স্থাপত্য বিষয়ক ষড়যন্ত্র ও উপসাগরের একটি পশুপালক দেশ ও কিছু বিদেশি দেশের রাজনৈতিক ব্যবসায়ী দ্বারা। আর তা সমর্থন করেন কিছু স্বাধীনতা, পরিবর্তন, বামপন্থি এবং কমিউনিস্টদের অক্ষম সমর্থকদের দ্বারা। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করার চেষ্টা করা হয়।
তিনি আরও জানান, হেমেদতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও কিছু অর্থদাতাদের সঙ্গে দেখা করে জোর করে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন। আর এর মূল লক্ষ্য ছিল এতে সেনাবাহিনীকে আক্রমণ আর কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসহ পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোর দ্বারা স্বীকৃত সরকার ঘোষণা করা। হেমেদতি ‘রাজনীতি বা সুদান সম্পর্কে কিছুই জানেন না’ উল্লেখ করে মারুফ বলেন, সুদানের রাজনীতিবিদ এবং পিপলস লিবারেশন মুভমেন্টের (এসপিএলএম) নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ইয়াসির আরমানও তার ছায়ায় ছিল। আবুধাবি আরএসএফকে ব্যবহার করে সুদানে তার নিজস্ব স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির প্রভাব মোকাবিলা করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা বিশ্বের ঘটনায় প্রভাব খাটিয়েছে তার বিশাল সম্পদ ব্যবহার করে। চলমান অস্থিরতা ও লিবিয়া ও ইয়েমেনে ভাড়াটে সৈন্যদের অর্থায়নেও এই দেশের ভূমিকা সুপরিচিত।
২০২০ সালে মার্কিন পেন্টাগন দাবি করেছিল, আবুধাবি লিবিয়ায় রুশ ভাড়াটে ওয়াগনার গ্রুপকে অর্থায়নে সহায়তা করেছে। জেনারেল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (এলএনএ) সহায়তা প্রদান করেছিল। এলএনএতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থনের মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং বিমান সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি এ পক্ষে লড়াইয়ে সুদান এবং সিরিয়ার মতো দেশ থেকে ভাড়াটে লোক নিয়োগ করা অন্তর্ভুক্ত আছে। সুদানে হেমেদতির ক্ষমতা এবং প্রভাবে দেশটির সাহায্যের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত-মিত্র বাহিনীকে সমর্থন করার জন্য ১,০০০ আরএসএফ যোদ্ধা পাঠানো হয়েছিল।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ২০১৯ সালে সুদান আরএসএফ তহবিল থেকে সুদান সেন্ট্রাল ব্যাংককে ১ বিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন জেনারেল হেমেদতি। বিপুল এই অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় নিজেই বলেছিলেন, আরব আমিরাত তার ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর প্রধান উপকারকারী দেশ। বিদেশি রাষ্ট্রে সেনা ভাড়া, স্বর্ণ বাণিজ্য এবং বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগ থেকে মোটা মুনাফা আসে আরএসএফের তহবিলে।
চলমান সহিংসতায় দায়ী আরএসএফ: দেশে চলমান সহিংসতার জন্য আরএসএফকে দায়ী করেছেন যুক্তরাজ্যে সুদানের উপরাষ্ট্রদূত খালিদ মোহাম্মদ আলি হাসান। সুদানের দুই জেনারেলের মধ্যে সৌদি-মার্কিন-মধ্যস্থতায় ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আরব নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সময় তিনি বলেন, আরএসএফকে রক্তপাতের দায় নিতে হবে। এ সময় তিনি সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে দলটিকে দ্রুত ফের যোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন। আরএসএফ একসময় সুদানের সামরিক বাহিনীর একটি অংশ ছিল বলে জানান। বর্তমান সংঘাতের সমাপ্তি কী ঘটবে-এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আরএসএফকে তার নিজস্ব অস্ত্র জমা দিতে হবে ও এসএএফে পুনরায় যোগ দিতে হবে। আরও বলেন, ‘বিশ্বের জানা দরকার, এটি দুই জেনারেলের মধ্যে যুদ্ধ নয় বরং এটি আরএসএফ বাহিনী দ্বারা তৈরি একটি বিদ্রোহ। এ সময় তিনি সৌদি সরকারকে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানান।
বিএস/