প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩, ০১:০৬ এএম
ভারতীয় এয়ারলাইন এয়ার ইন্ডিয়ার একটি আন্তর্জাতিক রুটে মহিলা সহযাত্রীর গায়ে মদ্যপ অবস্থায় মূত্রত্যাগ করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দিল্লি পুলিশ শনিবার গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু তাতেও এ নিয়ে আলোড়ন তো থামেইনি, বরং সারা দেশজুড়ে নজিরবিহীন চর্চা ও অব্যাহত তর্কবিতর্ক চলছে মাঝ-আকাশের সেই ঘটনা নিয়ে। প্রবল তোপের মুখে পড়েছে এয়ার ইন্ডিয়াও, যারা গত বছর পর্যন্তও দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার ছিল।
বিবিসি জানিয়েছে, শঙ্কর মিশ্র নামে অভিযুক্ত ওই যাত্রী বেশ কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর অবশেষে ব্যাঙ্গালোর থেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন – দিল্লি পুলিশ তার বিরুদ্ধে পিনাল কোডের অন্তত পাঁচটি ধারায় চার্জ এনেছে। তবে দিল্লির মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত তার পুলিশি হেফাজতের আবেদন মঞ্জুর করেনি – তার বদলে ১৪ দিনের বিচারবিভাগীয় হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দিল্লি পুলিশ এয়ার ইন্ডিয়ার সেই ফ্লাইটের পাইলটসহ মোট আটজন ক্রুকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করছে। তদন্ত শেষ না-হওয়া অবধি এয়ার ইন্ডিয়া তাদের সবাইকে ‘গ্রাউন্ড’ করে রেখেছে, অর্থাৎ ডিউটি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ৩৪ বছর বয়সী মিশ্র চাকরি করতেন মুম্বাইতে মার্কিন ফিনান্সিয়াল সার্ভিস সংস্থা ওয়েলস ফার্গোর খুব উঁচু পদে। কিন্তু গত শুক্রবারই ওয়েলস ফার্গো প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করার কথা ঘোষণা করেছে।
ইতিমধ্যে গত বেশ কয়েকদিন ধরে ভারতের প্রায় সব টিভি চ্যানেল ও জাতীয় পর্যায়ের খবরের কাগজে শিরোনাম জুড়ে আছে এই খবর। সোশ্যাল মিডিয়াতেও যে এই ঘটনা নিয়ে কত ‘মিম’ ঘুরছে এবং কত ধরনের বিচিত্র আলোচনা চলছে তার ইয়ত্তা নেই। এয়ার ইন্ডিয়ার এই ঘটনার সঙ্গে ভারতীয়দের উন্মুক্ত জায়গায় মূত্রত্যাগের স্বভাবের কোনও সম্পর্ক আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন অনেকে।
এই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি জনৈক ‘মিশ্র’ না-হয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলে ভারতের মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া কী হত, সে প্রশ্নও খুঁচিয়ে তুলেছেন দেশের একজন নামী সাংবাদিক। বলিউডের একটি মহল থেকে তার জবাবও এসেছে দ্রুত। ভারতের সবচেয়ে পুরনো এয়ারলাইন এয়ার ইন্ডিয়া – যা মাত্র গত বছরেই টাটা শিল্পগোষ্ঠী কিনে নিয়েছে – তাদের যে এই ঘটনায় তীব্র বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ২৮ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে তাদের দিল্লিগামী বিমানে ওই বিশ্রী ঘটনাটি ঘটার পর কেন তারা অভিযুক্ত যাত্রীর বিরুদ্ধে পুলিশে কোনও অভিযোগ দায়ের না-করেই তাকে চলে যেতে দিয়েছিল, এটাই তাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ।
ফ্লাইটের বিজনেস ক্লাসে যে বয়স্কা মহিলার সঙ্গে এই ঘটনাটি ঘটে, তিনি তার অভিযোগপত্রে জানিয়েছেন ফ্লাইটের শেষে তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তির মুখোমুখি বসিয়ে ঘটনাটি মিটমাট করে নিতে কার্যত বাধ্য করা হয়েছিল। ওই ব্যক্তি রীতিমতো কান্নাকাটি করে তার কাছে ক্ষমা চান এবং নিজের পরিবারের কাছ থেকে ঘটনাটি আড়াল রাখতে কোনও অভিযোগ না-করার জন্যও অনুরোধ জানান বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।
এখানেই এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানকর্মীরা চরম অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন বলে ভারতে অনেক বিশেষজ্ঞই মতামত দিয়েছেন। তা ছাড়া মাঝ-আকাশে ওই ঘটনা ঘটার পর মহিলা যাত্রীকে কেন তার আগের সিটেই বসতে বলা হয়েছিল – কেন তাকে ফার্স্ট ক্লাসে আপগ্রেড করে দেয়া হয়নি, এই অভিযোগে ফ্লাইটের পাইলটের দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন অনেকেই। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অন্য যাত্রীরাও ইতিমধ্যে সামনে এগিয়ে এসে মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ওই ঘটনাতে বয়স্কা মহিলার শাড়ি, আসন যখন ভিজে গেছে এবং দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে – তখনও তাকে সেখানেই বসতে বলা হয়েছিল, তিনি রাজি না-হওয়ায় বিজনেস ক্লাসের গ্যালি এরিয়ায় কেবিন ক্রু-দের জন্য নির্দিষ্ট আসনে তাকে প্রায় দু’ঘন্টা বসে থাকতে হয়।
টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারপার্সন এন চন্দ্রশেখরন। ভিক্টিম মহিলা তাকে অভিযোগ জানানোর পরই এই ঘটনা সামনে আসে। তবে সুগত ভট্টাচার্য নামে ওই বিমানেরই এক যাত্রী, যিনি বিজনেস ক্লাসে অভিযুক্ত শঙ্কর মিশ্রর ঠিক পাশেই বসেছিলেন, তিনি ওই ঘটনার পর বিমানকর্মীদের ভূমিকার প্রশংসাও করেছেন। ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে হাত গ্লাভস পরে নিয়ে তারা যেভাবে ওই মহিলার সিটটি পরিষ্কার করতে লেগে পড়েন, দুর্গন্ধনাশক ও জীবাণুনাশক স্প্রে করেন এবং বাড়তি কম্বল এনে আসনটি শুকানোর জন্য বিছিয়ে দেন – সেটা অবশ্যই তারিফ করার যোগ্য ছিল।
তবে এভিয়েশন খাতের নামী বিশেষজ্ঞ কপিল কাউল বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘পুরো জিনিসটা যে এয়ার ইন্ডিয়ার জন্য একটা ‘পিআর ডিসঅ্যাস্টার’ বা বিজ্ঞাপনী বিপর্যয় তাতে কোনও সংশয় নেই।’ এয়ার ইন্ডিয়ার প্রতিযোগী সংস্থাগুলোও হয়তো এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্র্যান্ডকে বদনাম করতে উঠেপড়ে লেগেছে – কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া সেটা সামলাতে এখনও অবধি ‘পুরোপুরি ব্যর্থ’ বলেই মি কাউল মনে করেন।
সুপরিচিত রাজনৈতিক স্যাটায়ারিস্ট আকাশ ব্যানার্জি (যিনি ‘দেশভক্ত’ হ্যান্ডেলেই বেশি পরিচিত) আবার এই বিতর্কে অন্যরকম ‘স্পিন’ দিয়ে দাবি করেছেন, ফ্লাইটে অতিরিক্ত মদ্যপান করেই অভিযুক্ত ব্যক্তি ওই কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন এমনটা ভাবা ঠিক হবে না – বরং ভারতীয়রা যেখানে সেখানে খোলা জায়গায় যেভাবে আখছার মূত্রত্যাগ করে অভ্যস্ত সেই ‘সংস্কৃতি’টাই এর পেছনে দায়ী।
বলিউডের বিভিন্ন ছবিতে পর্যন্ত যেভাবে রসিকতার ছলে খোলা জায়গায় মূত্রত্যাগের কালচারকে ‘প্রোমোট’ করা হয়েছে, তার বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে মি ব্যানার্জি যুক্তি দিয়েছেন এই ব্যাপারটা আসলে ‘ভারতীয়দের ডিএনএতেই ঢুকে গেছে’। তার এই মন্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে ইউটিউব ও টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনাও হচ্ছে বিস্তর।
ভারতের প্রথম সারির দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া আবার তাদের কার্টুনে এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্ক টেনেছে ভারতের কৃষকদের সার সঙ্কটের। তাদের কার্টুনিস্ট সন্দীপ আধোয়ারিউ এঁকেছেন, একজন কৃষক আকাশের দিকে হতাশ হয়ে চেয়ে আছেন – তার পরিবার তাকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি কি বৃষ্টির আশায় তাকিয়ে আছো? পরের ছবিতেই দেখা যাচ্ছে আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটি বিমান – আর সেই কৃষক বলছেন এটা থেকেও কোনও ইউরিয়া পড়লো না!
ঠাট্টা-রসিকতার বাইরে এই বিতর্কে একটি সিরিয়াস মাত্রা যোগ করেছেন ভারতের নামী সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই। তিনি টুইট করেছেন, “অভিযুক্তের নাম শঙ্কর মিশ্র না-হয়ে যদি কোনও ‘খান’ হত, তাহলে কী হত একবার ভাবুন। টিভির প্রাইম টাইমে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে এতক্ষণে কীভাবে ছিঁড়ে ফেলা হত! অথচ আইন তো মিশ্র বা খান, সবার জন্যই সমান হওয়া উচিত।”
বলিউড নির্মাতা ও ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী আবার এর পাল্টা জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘আইন সবার জন্যই সমান – সে আরফা-ই হোক, বা রাজদীপ। বৈষম্যটা মিডিয়াই করে থাকে, যেটাকে আপনারাই আবার ‘শকুন মিডিয়া’ বলে থাকেন।’ বিবেক অগ্নিহোত্রী আরও লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত অভিযুক্তের নাম খান হলে আপনারাই এতক্ষণে তাকে ভিক্টিম বানিয়ে ছাড়তেন।’ ফলে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে সেই চরম অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার দেড় মাস পরেও তা নিয়ে তর্কবিতর্ক বেড়েই চলেছে। সূত্র: বিবিসি।