প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৩, ০১:২৩ এএম
দশ বছরের মালকি এতই উচ্ছ্বসিত যে ভোরে কোনোভাবেই আর বিছানায় থাকতে চাইছিল না। অন্য চার ভাই-বোনের চেয়ে এক ঘণ্টা আগেই সে ঘুম থেকে উঠেছে, যাতে নখের লাল নেইলপলিশ তুলে ফেলতে পারে। তার এই উচ্ছ্বাসের কারণ, আবারও সে স্কুলে ফিরছে, সেজন্যই পরিপাটি হতে চায়।
মালকি ফের স্কুলে ফেরার সুযোগ পেলেও অন্য ভাইবোনদের বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। তার পরিবার এখন সবার পড়ালেখার খরচ চালাতে অক্ষম, এজন্য কেবল সে-ই স্কুলে যাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর দেখা সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ছয় মাস আগেও ভয়াবহ কঠিন সময় দেখেছে শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক সংকটে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পর দ্বীপ দেশটির পরিস্থিতি এখন তুলনামূলক শান্ত হলেও ব্যাপক বেকারত্ব ও উচ্চ দ্রব্যমূল্যের প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে পরিবারগুলোতে।
আর্থিক দূরাবস্থায় পড়ালেখায় ছেদ পড়ার পর আবারও স্কুলে যাচ্ছে মালকি।
মা-বাবাদের দুঃস্বপ্ন
দেশের অর্থনৈতিক সংকটে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেলে ঠিকমতো সংসারই চালাতে পারছিলেন না মালকির মা প্রিয়ন্তিকা। তার মধ্যে পাঁচ সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালানো হয়ে যায় দুঃস্বপ্নের মতো।
উপায়ান্তর না দেখে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখায় ইতি টানেন। সংসারের ব্যয় সামলাতে তার সন্তানদের নেমে পড়তে হয় আতশবাজি বিক্রির কাজে।
মূল্যস্ফীতি সর্বকালের সবচেয়ে উঁচু ৯৫ শতাংশে পৌঁছানোর পর শ্রীলঙ্কায় খাদ্যপণ্যের দামও পৌঁছে যায় রেকর্ড উচ্চতায়। কোনো কোনোদিন মালকির পরিবারের সবাইকে না খেয়েও থাকতে হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় স্কুল ফ্রি, কিন্তু সেখানে খাবার দেওয়া হয় না। আর এর সঙ্গে যদি স্কুলের পোশাক আর যাতায়াতের খরচ যোগ হয়, তাহলে এখন এমনই ‘বিলাসিতা’ যে সেসব মেটানোর সাধ্য প্রিয়ন্তিকার এখন নেই।
বিবিসিকে এ নারী জানান, তার সব ছেলেমেয়ে যদি আবার স্কুলে ফেরে তবে প্রত্যেকজনের জন্য তার প্রতিদিন ৪০০ রুপি করে প্রয়োজন।
এক বেডরুমের ঘরে, সবার ভাগাভাগি করে যে বিছানায় শোয়, সেখানে বসে কথা বলছিলেন আর অনবরত চোখ মুছছিলেন প্রিয়ন্তিকা।
“ছেলেমেয়েদের সবাই স্কুলে যেত। কিন্তু এখন তাদের স্কুলে পাঠানোর মতো টাকা নেই আমার কাছে”, বলেন তিনি।
পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে মালকি স্কুলে যেতে পারছে কারণ তার স্কুলের জুতা আর ইউনিফর্ম এখনও ঠিক আছে।
এদিকে বিছানায় শুয়ে থাকা তার ছোট বোন দুলানজালি স্কুলে না যেতে পেরে কাঁদছে।
“সোনা মা, কেঁদো না। আমি দেখছি, কাল তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবো”, দুলানজালিকে বলছিলেন প্রিয়ন্তিকা।
বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সাদা সুতির ইউনিফর্ম পরে নোংরা রাস্তা ধরে, মোটরসাইকেল বা টুকটুকে চড়ে স্কুলের পথে ছুটতে হয় শিশুদের।
কিন্তু স্কুলগুলোর অবস্থা কেমন? সেই প্রসঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন কলম্বোর কোটাহেনা সেন্ট্রাল সেকেন্ডারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রক্রমা বীরসিংহ। অর্থনৈতিক দূরাবস্থার চিত্র যে প্রতিদিনই চোখে পড়ছে তার।
“যখন স্কুলের সময় শুরু হয়, সকালের সমাবেশ করি, তখন ক্ষুধায় অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা হয় শিশুদের,” বলেন তিনি
সরকার বলেছে, তারা স্কুলে খাবারের ব্যবস্থা করেছে। তবে কিছু কিছু স্কুলে যোগাযোগের পর তারা বিবিসিকে এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য না পাওয়ার কথা জানায়।
বীরসিংহ জানান, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ৪০ শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। এরপর শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে অতিরিক্ত খাবার আনতে তিনি শিক্ষকদের বাধ্য করেন।
সিলন শিক্ষক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জোসেফ স্ট্যালিনের মনে করেন, স্কুলের ব্যয় সামলাতে না পেরে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা বন্ধ করা ক্রমবর্ধমান পরিবারগুলো সম্পর্কে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবেই উদাসীন।
“কেবল আমাদের শিক্ষকরাই খালি লাঞ্চ বক্সগুলো দেখছেন। এই অর্থনৈতিক সংকটের প্রকৃত শিকার শিশুরা। এই সমস্যার কোনো সমাধান খুঁজছে না সরকার। তাদের বদলে ইউনিসেফ ও অন্যরা এই ইস্যুকে দেখছে ও এটি যে সমস্যা তা চিহ্নিত করছে।“
ইউনিসেফ বলছে, আসছে মাসগুলোতে মানুষের পক্ষে খাবার জোগাড় করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে। চালের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা পরিবারগুলোকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। এর ফলে সারা দেশে আরও অনেক শিশু ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হবে বলেই মনে হচ্ছে ।
শেষ ভরসা কী?
আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি সামলাতে সরকার অক্ষম হওয়ায় দাতা সংস্থাগুলোকেই পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
সমতা সরনা- এমনই একটি খ্রিস্টান দাতব্য প্রতিষ্ঠান, যারা তিন দশক ধরে কলম্বোর সবচেয়ে দরিদ্র শিশুদের সাহায্য করে আসছে।
পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, রাজধানীতে সমতা সরনার খাবারের হল এখন বিভিন্ন স্কুলের ক্ষুধার্ত শিক্ষার্থীতে ভরে যাচ্ছে।
প্রতিদিন ২০০ শিশুকে খাবার দিকে পারে প্রতিষ্ঠানটি, কিন্তু চাহিদা মেটাতে তাদেরকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।
দুপুরের খাবারে জন্য বন্ধুদের সঙ্গে সমতা সরনার হলে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল মনোজ।
“তারা (সমতা সরনা) আমাদের খাবার দেয়, বাড়ি ফেরার জন্য বাস দেয়। তারা আমাদের সবকিছু দেয়, সেজন্য আমরা পড়ালেখা করতে পারছি,” বলে পাঁচ বছরের এ শিশু।
এদিকে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে মালকি তার মাকে প্রথমদিন স্কুলে বন্ধুদের দেখে তার কী যে আনন্দ হয়েছে, সে গল্প বলছিল। সঙ্গে জানাচ্ছিল, তার এখন নতুন একটা খাতা দরকার, শিক্ষকরা একটি স্কুল প্রজেক্টের সরঞ্জাম কিনতে টাকাও চেয়েছেন।
কিন্তু এই টাকাই তো এখন মালকিদের কাছে নেই।
“আজকের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে কাল কী খাব সেই চিন্তায় থাকতে হয়। এখন এটাই আমাদের জীবন হয়ে গেছে,” প্রিয়ন্তিকার মুখ থেকে বের হয়ে এল সেই দুশ্চিন্তার কথা, যা এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার অসংখ্য পরিবারের নিত্য সঙ্গী।