• ঢাকা শনিবার
    ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১

জীবন বাঁচাতে বোরকা পরে কাবুল ছাড়লেন নারী গভর্নর

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২১, ০৭:৪০ পিএম

জীবন বাঁচাতে বোরকা পরে কাবুল ছাড়লেন নারী গভর্নর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আফগানিস্তানের ইতিহাসে তিনজন মহিলা গভর্নরের কথা জানা যায়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন একটু ব্যতিক্রম। নারী হলেও তিনি ছিলেন সাহসী এক যোদ্ধা। বিশেষ করে তালেবানের কাছে আতঙ্ক ছিলেন তিনি। তালেবানের বিরুদ্ধে বন্দুক হাতে লড়াই করতেও তার কৃতিত্ব কম নয়। তিনি হচ্ছেন আফগানিস্তানের বল‌্খ প্রদেশের গভর্নর সালিমা মাজারি। সেদিনও তার কড়া প্রতিরোধের সামনে অসহায় ছিল তালেবান। তার কৃতিত্বে দীর্ঘদিন চহার এলাকা ছিল তালেবানের নাগালের বাইরে।

অন্যসব এলাকার মতো বল‌্খ-এর পতনের পর থেকে খোঁজ মিলছিল না সালিমা মাজারির। তার বিষয়ে বিভ্রান্তি কম ছিল না। কেউ দাবি করছিলেন সালিমা তালেবানের বন্দুকের নিশানায় পড়ে গিয়েছেন। আবার কারও দাবি ছিল তিনি বেঁচে আছেন এবং লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে বেশ কয়েকদিন চরম উৎকণ্ঠায় কাটানোর পর অবশেষে খবর, সালিমাকে আমেরিকার একটি অজ্ঞাত জায়গায় নিরাপদে রাখা হয়েছে।

বল‌্খ প্রদেশের অন্তর্গত চহার কিন্ত। এই শহরের গভর্নর হিসেবে কাজ করেছেন সালিমা। তার পরিচিতি ছিল কড়া প্রশাসন পরিচালনায়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, শতাধিক তালেবান যোদ্ধাকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন সালিমা। সম্প্রতি যখন তালেবান আগ্রাসনের মুখে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়়েছে যাবতীয় আফগান প্রতিরোধ, তখন ব্যতিক্রম সালিমার চহার কিন্ত। একমাত্র এই এলাকায় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে বারবার পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে তালেবান। কিন্তু গোটা দেশ দখল সম্পূর্ণ হওয়ার পর, চহার কিন্ত-এর প্রতিরোধের আয়ুও যে ক্রমেই কমছে, তা বুঝতে ভুল করেননি সালিমা।

আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে কর্মরত দুই সাংবাদিকের সহায়তায় দেশ ছাড়তে পেরেছেন সালিমা। কিন্তু তার দেশত্যাগের বৃত্তান্ত কম রোমহর্ষক নয়। বল‌্খ পতনের পরই পরিস্থিতি জরিপ করে যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন সালিমা। স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে সালিমা রওনা দেন আফগানিস্তান-উজবেকিস্তান সীমান্তের হয়রতনের দিকে। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন। উজবেকিস্তান সালিমাকে আশ্রয় দিতে আপত্তি করে। উল্টো সালিমার জায়গায় উজবেকিস্তানে আশ্রয় পান সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল রশিদ দোস্তম, বল‌্খ-এর সাবেক গভর্নর এবং মুজাহিদিন কমান্ডার আটা মহম্মদ নূর প্রমুখ।

উজবেকিস্তানে ঢুকতে না পেরে পরিবার নিয়ে কাবুল চলে আসেন সালিমা। তখন বিপদ চার দিকে। তালেবান সালিমার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরছে, অন্য দিকে রয়েছে পাকিস্তানের আইএসআই। তালেবানি নজর এড়াতে বোরকা পরতে শুরু করেন সালিমা। বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই গাড়ি নিয়ে কাবুল আসেন সালিমা। পথে বারবার তালেবানি চেক পোস্টে গাড়ি আটকে তল্লাশি হলেও তাকে চিনতে পারেননি কেউ। প্রতিবারই এই বুঝি পরিচয় বেরিয়ে গেল, এই আতঙ্ক গ্রাস করেছিল সালিমার পরিবারকে।

কাবুলের অজ্ঞাত জায়গায় এসে পড়ার পর সালিমা যোগাযোগ করেন বন্ধুদের সঙ্গে। জানান, যেকোনো মুহূর্তে তালেবানের হাতে পড়বেন। সেই সময় আমেরিকার টাইম পত্রিকার দুই সাংবাদিকের সঙ্গেও যোগাযোগ হয় সালিমার। তারাও সালিমাকে দেশ থেকে বের করে নিতে পদক্ষেপ নেন। গত ২৩ আগস্ট একটি অচেনা নম্বর থেকে বার্তা পান সালিমা। সেখানে বলা হয়, আমেরিকান রেসকিউ অপারেশন সেলের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। সেই নম্বরে নিজের ও পরিবারের সমস্ত তথ্য দেন সালিমা। এমনকি নিজের লোকেশনসহ ছবিও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পর সন্দেহ হয়, আমেরিকার উদ্ধারকারী দল কেন দাড়ি ভাষায় বার্তা পাঠাবে? মূলত পাক সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানে প্রচলিত এই ভাষা। তাহলে কি আমেরিকার উদ্ধারকারী দলের ভেক ধরে সালিমার সমস্ত তথ্য হাতিয়ে নিলো পাক আইএসআই?

পরে অবশ্য এক সাংবাদিকের তদন্তে দেখা যায়, আমেরিকার উদ্ধারকারী দলের তরফেই যোগাযোগ করা হয়েছিল সালিমার সঙ্গে। পরিকল্পনা ছিল, ২৪ আগস্ট একটি হেলিকপ্টারে প্রথমে সালিমা ও তার পরিবারকে গোপন আস্তানা থেকে উদ্ধার করে কাবুল বিমানবন্দরে আনা হবে। তার পর আমেরিকার উদ্ধারকারী বিমানে তুলে দেওয়া হবে তাদের। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে কোনো বার্তা না পেয়ে সন্ধ্যায় মরিয়া হয়ে সালিমা পরিবার নিয়ে হাঁটা দেন কাবুল বিমানবন্দরের দিকে। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ যেকোনো মুহূর্তে তাকে চিনে ফেলার ভয়ের পাশাপাশি, সামগ্রিক অশান্তির জেরেও বিপদ বাড়তে পারে। শেষ পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই বিমানবন্দরে পৌঁছেন সালিমা। ২৫ আগস্ট কাকভোরে সালিমার পরিবারকে নিয়ে আকাশে ওড়ে আমেরিকার উদ্ধারকারী বিমান। তালেবান কবল থেকে অবশেষে মুক্তি আফগানিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম প্রথম মহিলা গভর্নরের।

হাজারা সম্প্রদায়ের সালিমা ও তার পরিবারকে প্রথমে কাতার এবং তারপর আমেরিকার একটি অজানা জায়গায় রাখা হয়েছে। তিনি নিরাপদে রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।

শামীম/এম. জামান

আর্কাইভ