• ঢাকা রবিবার
    ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

ডেঙ্গু চিকিৎসায় ‘ভরসা’ মুগদা হাসপাতাল, ঠাঁই নেই মেঝেতেও

প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২৩, ০২:২১ এএম

ডেঙ্গু চিকিৎসায় ‘ভরসা’ মুগদা হাসপাতাল, ঠাঁই নেই মেঝেতেও

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। ইতোমধ্যে এ বছরে রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে গেল জুন মাসে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু সংক্রমণের হার যদি এভাবেই বাড়তে থাকে, জুলাই মাসে ছাড়িয়ে যাবে পূর্ববর্তী সব শনাক্তের রেকর্ড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে (৩ জুন দুপুর পর্যন্ত) সবচেয়ে বেশি ২৫১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মুগদা হাসপাতাল ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য ভরসার কেন্দ্রের পরিণত হয়েছে। রাজধানীর যেকোনো এলাকাতেই কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ছুটে আসছেন মুগদা হাসপাতালে। এদিকে চিকিৎসা সেবায় রোগীদের আস্থা বাড়ায় ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব হয়ে পড়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা পরিপূর্ণ হওয়ায় ফ্লোরেই বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্তরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগীর তুলনায় অবকাঠামো এবং জনবলের সীমাবদ্ধ থাকায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।

রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ রোগীই প্রথম অবস্থায় জানতো না যে তিনি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। জ্বরের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত শরীর এবং মাথা ব্যথা যুক্ত হওয়ার এক-দুইদিন পর হাসপাতালে পরীক্ষায় ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। তবে, শেষ মুহূর্তে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত সেবায় সুস্থ হয়ে সন্তুষ্টির হাসি তাদের মুখে।  

dhakapost

রাজধানীর মুগদার মান্ডা এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ইমরান হোসেন। সিটি নিউজ ঢাকাকে তিনি বেলেন, আমি গত রোববার থেকে বুঝতে পারি যে আমার হালকা জ্বর। এর সঙ্গে যোগ হলো শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা। এর দু’দিন পর গিয়ে আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি, রিপোর্টে বুঝতে পারি যে আমি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। এরপর দ্রুতই হাসপাতালে ভর্তি হই। 

তিনি বলেন, এখন শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো, বাসায় গিয়ে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছিলাম, গতকাল আবার একটু অসুস্থ লাগছিল, তাই আবার হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছি। 

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর রায়েরবাগ কদমতলি এলাকা থেকে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন আহসান হাবিব সুজন। তিনি বলেন, গত ২৮ জুন ভোর বেলা থেকেই কিছুটা জ্বর-জ্বর লাগছিল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। এরপর রাত থেকেই অনেক জ্বর এলো, তখনও আমরা ভেবেছি স্বাভাবিক জ্বর। কেউই ভাবিনি যে আমার ডেঙ্গু হয়েছে। সবশেষে টিকতে না পেরে ঈদের দিন (২৯ জুন) এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করলাম এবং জানতে পারলাম আমার ডেঙ্গু পজিটিভ।

dhakapostতিনি বলেন, ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম কোথায় গিয়ে ভর্তি হবো, শেষমুহূর্তে সবাই মুগদা হাসপাতালে এসে ভর্তির পরামর্শ দিলো এবং এখানে এসেই ভর্তি হলাম। আলহামদুলিল্লাহ খুব দ্রুতই সুস্থতার দেখা পেয়েছি।

আহসান হাবিব বলেন, জীবনে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছি। কিছুটা ভয় লেগে গেছে। প্রথম দু’দিন আমার খুব খারাপ অবস্থা ছিল। মাথা প্রচণ্ড ব্যথা ছিল, সহ্য করার মতো না। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। 

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান সিটি নিউজ ঢাকাকে বলেন, ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমার হাসপাতালে। গতকাল সকাল থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আমার হাসপাতালে রোগী ভর্তিরত আছেন ২৫১ জন। এরমধ্যে গত একদিনে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৮৪ জন। 

কোন এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন আর নির্দিষ্ট কোনো এলাকা থেকে আসছে না। এখন সারা ঢাকা থেকেই রোগী আসছে। যদিও এর আগে সবাই বলতো যে, কাজলা, যাত্রবাড়ী, মান্ডা, মুগদা, বনশ্রী থেকে বেশি রোগী আসছে, কিন্তু এখনকার আমার পর্যবেক্ষণ হলো ডেঙ্গু এখন সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এমনকি আমাদের হাসপাতালে ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী এসে ভর্তি হচ্ছে।

ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, যদিও ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমরা সামাল দিচ্ছি, আমাদের জনবল কিন্তু খুব বেশি নেই। তাছাড়া, আমরা শুধু ডেঙ্গু রোগেরই চিকিৎসা দিচ্ছি না। সব ধরনের রোগীই আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। স্বল্প জনবলে একসঙ্গে সব সামলাতে কষ্ট হচ্ছে, তারপরও তো কিছুই করার নেই। আমার হাসপাতালে রোগী এলে তাকে তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না।

তিনি বলেন, আমার নার্সের সংকটও তীব্র, ডাক্তারের সংকটও তীব্র। তারপরও আমরা ম্যানেজ করে চালিয়ে নিচ্ছি। এক্ষেত্রে রেশনিং করতে হচ্ছে। যেখানে আমাদের অন্য একটা ওয়ার্ডে তিনজন চিকিৎসকের ডিউটি করার কথা, সেখানে দু’জন দিয়েই ২৪ ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। এরপরও ভালো লাগার বিষয় হলো, আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের সেবায় সুস্থ হয়ে রোগীরা ঘরে ফিরছে।

প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই (শনিবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ২৩৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১২৩, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে ৭৩ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ২৫ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ২৪ জন এবং শিশু হাসপাতালে ১৯ জনসহ সরকারি ২০টি হাসপাতালে সর্বমোট রোগী ভর্তি আছেন ৫৯৮ জন।

এদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে, সেখানে ৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এছাড়াও আজগর আলী হাসপাতালে ৩৬ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ২৪ জন, আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জনসহ ৩৩টি বেসরকারি হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন ৩৪৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে সোমবার পাঠানো সব শেষ তথ্য মতে,  বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১৫৩১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১০২২ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫০৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৯১৯৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৬৬৫৫ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৫৩৮ জন।

আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭৬০৬ জন। ঢাকায় ৫৫৮৯ এবং ঢাকার বাইরে ২০১৭ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

আর্কাইভ