প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৩, ০৭:৩৬ পিএম
জলবসন্ত বা চিকেন পক্স অত্যন্ত সংক্রামক রোগ, যা ভেরিসেলা জোস্টার ভাইরাসের মাধ্যমে হয়। গরম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাইরাসটির আক্রমণ বেশি দেখা দেয়। ছোট-বড়, নারী-পুরুষ যে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের হার একটু বেশি।
এসএসকেএম-এর সংক্রামক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. যোগিরাজ রায় বলেন, জলবসন্ত ছোট-বড় সবাইকে আক্রমণ করে। এটি খুবই ছোঁয়াচে একটি রোগ। এ রোগে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় এই অস্বস্তিকর অবস্থা থাকে। প্রথমে সামান্য জ্বর হতে পারে, এরপর ফোসকা পড়ে, চুলকানি হয়। অবশেষে ফোসকা থেকে শুকনা মরা চামড়া উঠে আসে। এ রোগের লক্ষণ হলো গায়ে প্রচণ্ড জ্বর হয়, হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফোসকার মতো দেখা দেয়। এই রোগ সাধারণত একটু সচেতন থাকলে কয়েক দিনেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ত্বকের দাগ থেকে যেতে পারে দীর্ঘদিন। শিশুর শরীরে দ্রুত জটিলতা দেখা দেয় বিধায় প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
কী কারণে হয়?
জলবসন্ত বা চিকেনপক্স একটি সংক্রামক রোগ, যা ভেরিসেলা জোস্টার নামক একটি ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে হয়ে থাকে।
কীভাবে ছড়ায়?
এই রোগ দ্রুত বাতাসের মাধ্যমেই একে অন্যকে আক্রমণ করে। তা ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, কাপড়চোপড় বা আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে জলবসন্তের ফলে সৃষ্ট ফোসকা ফেটে গিয়ে যে পদার্থ নির্গত হয়, তা অন্যের সংস্পর্শে এলে এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে—ভাইরাসটি ছড়াতে থাকে যত দিন না সব কটি গুটি শুকিয়ে যায়। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেই এটি ছড়াতে শুরু করে।
লক্ষণ
ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের ১০-১২ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ হয়ে থাকে। শুরুর দিকে শরীর ম্যাজম্যাজ করা, মাথাব্যথা করা, গা-হাত-পা ব্যথা করা, এমনকি পিঠেও ব্যথা হতে পারে। একটু সর্দি-কাশিও হতে পারে। এরপর জ্বর জ্বর ভাব হবে। এগুলো রোগের পূর্বলক্ষণ।
পরে ত্বকে প্রথমে ঘামাচির মতো গুটি উঠতে থাকে, যা ফুসকুড়িতে পরিণত হয়। ফুসকুড়ি দেখা দেয়ার ২-৩ দিন আগে থেকেই শরীর ব্যথা অনুভূত হয়, জ্বর দেখা দেয়, পেটব্যথা হতে পারে। লালচে ফুসকুড়িতে চুলকানি ও জ্বালাপোড়া অনুভূতি হয়। ফুসকুড়িতে পানি জমে, যা পরবর্তীতে শুকিয়ে কালো বর্ণের খোসায় পরিণত হয়। কাশি ও পাতলা পায়খানাও হতে পারে। সাধারণত ২ সপ্তাহ থেকে ১ মাস পর্যন্ত এই রোগের স্থায়িত্ব হয়ে থাকে।
চিকিৎসা
ভাইরাসজনিত রোগ বিধায় এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। সাবধানতা অবলম্বন ও পরামর্শ মেনে চললে এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে অনেক সময় লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ দেয়া হয়। যেমন- জ্বর বা চুলকানি নিয়ন্ত্রণের জন্য। আবার রোগের তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে কখনো কখনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নাশক ওষুধও দেয়া হয়ে থাকে।
মনে রাখবেন জলবসন্ত বা চিকেনপক্স একটি খুবই সাধারণ তবে ছোঁয়াচে রোগ। সাবধানতা অবলম্বন ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই এ রোগ থেকে সুস্থতা লাভ করা যায়।
খাবার
জলবসন্তে শরীর বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই জোর দিতে হবে খাওয়াদাওয়ার ওপরে। বসন্ত রোগীর ডায়েটে কোনও বিধিনিষেধ নেই, নিরামিষ, আমিষ সব খাবার খাওয়া যায়।
এ সময়ে শরীরে ক্যালোরি, প্রোটিন দরকার। লাইসিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তবে পথ্য হবে সহজপাচ্য। যেমন- পাতলা মাছের ঝোল, পনির, ডিমের সাদা অংশ, তেতো ইত্যাদি। কিন্তু চিকেনপক্স যেহেতু ত্বক ছাড়াও গলার ভিতরের মিউকাস পর্দায় হয়ে থাকে, তাই গরম, অধিক টক, ঝাল বা নুন-সমৃদ্ধ খাবার রোগীর খেতে অসুবিধে হয়। সে দিকটা খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণে ফ্লুইড দরকার। পানির পাশাপাশি রোগীর পছন্দ অনুযায়ী ফলের রস, মিছরির শরবত, আলু সিদ্ধ, গলা ভাত ইত্যাদি দিতে হবে।
ফিজিশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বলেন, পক্সের জন্য চোখে যাতে ক্ষতি না হয়, তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন ‘এ’-র এবং আয়রনের সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন। সেরে ওঠার পরে বেশ কিছু দিন ভিটামিন ‘ই’ সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন, এতে ত্বকের দ্রুত রিকভারি হয়।
সচেতন হতে হবে
জলবসন্ত হলে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন থাকলে বিপদমুক্ত থাকা যায়। এ সময়ে জ্বর হলে অনেকেই ধরে নেন ঋতু পরিবর্তের জন্য ঠান্ডা লেগে জ্বর হয়েছে। ভাবনাতেও আসে না যে বড় বয়সে আবার পক্স হতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ না নিশ্চিন্ত হচ্ছেন জ্বরের রকমফের নিয়ে, ততক্ষণ বাইরে না বেরোনোই ভাল। এ ছাড়া আক্রান্তের হাঁচি, কাশি বাতাসে ভেসে সংক্রমণ ছড়ায়। তাঁদের থুতু ও ফোস্কার রসও ছোঁয়াচে। পক্স একদম শুকিয়ে গেলে ফোস্কার উপরের শুকনো চামড়া বা খোসা উঠতে শুরু করে। এটিও সংক্রামক। তাই সেগুলো একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়।
প্রতিদিন ঈষদুষ্ণ পানিতে নিমপাতা ফেলে হালকা করে গা মুছিয়ে দিতে পারেন। খেয়াল রাখতে হবে যাতে ঘষা না লাগে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ক্যালামাইন জাতীয় লোশন লাগানো যেতে পারে।
বয়স্ক রোগীর ক্ষেত্রে রোজ অক্সিজেন লেভেল, রক্তচাপ মাপতে হবে। ডায়াবেটিকদের নিয়মিত গ্লুকোমিটারে শর্করার মাত্রা চেক করে নেয়া ভাল। যিনি বসন্তের রোগীকে সেবা করছেন তাকেও ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আগাম সচেতনতার জন্য ওষুধ খেতে হবে। তাকে ব্যবহার করতে হবে মাস্ক ও গ্লাভস। চেষ্টা করতে হবে, তিনি যেন বাড়ির অন্য সদস্যদের থেকে দূরে থাকেন। প্রয়োজনে এ সময়ে বাড়ির বাচ্চা ও বয়স্কদের, বিশেষ করে যাদের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা আছে তাদের অন্যত্র থাকাই ভাল।
জলবসন্ত থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরে শরীর বেশ দুর্বল থাকে। তাই সেরে যাওয়ার পরে শরীর বুঝে কয়েক দিন পরে কাজে যোগ দেওয়া উচিত, বিশেষ করে যাদের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হয়।
এডিএস/