• ঢাকা মঙ্গলবার
    ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১

বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রতি চাই মানবিকতা, অবহেলা নয়

প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২২, ০৩:৩৩ পিএম

বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রতি চাই মানবিকতা, অবহেলা নয়

সিটি নিউজ ডেস্ক

আজ ২৮ মে বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। একজন নারীর জীবনে পূর্ণতা আনে মাতৃত্বের স্বাদ। আর সে মাতৃত্বকে নিরাপদ করতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে ১৯৮৭ সালে কেনিয়ার নাইরোবিতে কনফারেন্সে নিরাপদ মাতৃত্বের ঘোষণা করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ এ বিষয়ে অনুমোদন দেয়। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্যোগ টেকসই উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবছরের মতো এবারও ২৮ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস।

একজন মা গর্ভধারণের পর থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন। শুধু মা-ই নন, মাতৃগর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুরও যত্ন প্রয়োজন, যাকে বলা হয় গর্ভকালীন সেবা। এই গর্ভকালীন যত্নের লক্ষ্য হলো মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা। এক কথায় মায়ের স্বাস্থ্যের কোনো অবনতি না করে পরিবার, সমাজ ও দেশকে একটি সুস্থ শিশু উপহার দেওয়া। আর তাই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৮৬-৯০ সালে প্রতি লাখে ৫৭৪ জন, ১৯৯১-৯৫ সালে ৪৮৫, ১১৯৬ সালে ৪৪৮, ১৯৯৮-২০০০ সালে ৩২২, ২০০৭ সালে ২৯৮, ২০১০ সালে ১৯৪, ২০১৫ সালে ১৭৬, ২০১৮ সালে ১৬৯ এবং ২০১৯ সালে ১৬৫ জন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মৃত্যু হয়।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়, গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যু হার কমেছে, প্রতি লাখ জীবিত জন্মে প্রায় ৯৪ জন। এ পরিসংখ্যানে কিছুটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৭০ জনের নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে গেছে। ঘরে গর্ভপাতে নিরুৎসাহিত করতে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করছেন। বন্ধ করা হচ্ছে যত্রতত্র ও অস্বাস্থ্যকর ক্লিনিকে মায়েদের ডেলিভারি। অবস্থা পরিবর্তনে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো।

পরিবর্তন এসেছে পরিবার পরিকল্পনার সূচকেও। ২০১৯ সালে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৫ সালে যা ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ ছাড়া ঝরে পড়া ও অসম্পূর্ণ প্রয়োজনের (আনমেট নিড) হারও বেশ হ্রাস পেয়েছে, যা ছিল যথাক্রমে ৩৭ ও ১২ শতাংশ। প্রজনন সক্ষম (১৫-৪৯ বছর) নারীদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির প্রতি সন্তুষ্টির হার ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ, যা আগে ছিল ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ (এসভিআরএস-২০১৪)। শুধু অর্থনৈতিক সূচক নয়, বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে মানবসম্পদ সূচকেও গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি করেছে। জাতিসংঘের সূচকে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ। এই সূচকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মূলত শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫৩ জন। যেটি ২০১৮ সালে এসে প্রতি হাজারে মাত্র ২২ জনে নেমে আসে। এ ছাড়া বিবিএস ১৯৮১ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দিয়েছে প্রতি হাজারে ২১২ জন। যেটি ২০১৮ সালে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৯। ১৯৯১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। সেটি এখন ১ দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

গর্ভাবস্থা যদিও একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে সুখী পর্যায়গুলোর মধ্যে একটি, একই সঙ্গে গুচ্ছ মানসিক ও শারীরবৃত্তীয় চাপ তৈরি করে। অন্তঃসত্ত্বাদের তাই তাদের জীবনের এই পর্যায়ে নিজেদের যত্ন নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। যত্ন, খাদ্য এবং পুষ্টি বিষয়ে গর্ভাবস্থায় কোন খাবার খেতে হবে, তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অন্তঃসত্ত্বাদের নিজেদের এবং তাদের শিশুদের উভয়ের পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে উভয়ের জন্যই খেতে হবে। আর গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তঃসত্ত্বাদের প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৫০০ অতিরিক্ত ক্যালোরি প্রয়োজন। এই অতিরিক্ত ক্যালোরির প্রয়োজনের সঙ্গে ১ হাজার ২০০ মিলিগ্রামের ক্যালসিয়াম, ৬০০ থেকে ৮০০ মাইক্রোগ্রাম ফোলেট এবং ৭০০ মিলিগ্রামের লোহা প্রয়োজন।

একটি খাদ্যের মাধ্যমে ওপরের সব পুষ্টির প্রয়োজনীয়তাগুলো মেটানো কঠিন মনে হতে পারে; ভালো খবর এটাই যে, অতিরিক্ত পুষ্টি পাওয়া যতটা কঠিন মনে হয়, ততটা কঠিন নয়। আমাদের পুষ্টি গ্রহণ মূলত আমরা যে খাবার বেছে নিই, তার ওপর নির্ভর করে। এ জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, মৌসুমি ফল, শাকসবজি খেতে হবে। এ সময় প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার না খাওয়াই ভালো।

নারীর গর্ভকালীন প্রথম দু-তিন মাস ও শেষের তিন মাস অতিরিক্ত পরিশ্রম না করে হালকা হাঁটাচলা করা উচিত। ভারী জিনিস বহন করা বা তোলা যাবে না। পিচ্ছিল স্থানে হাঁটা যাবে না এবং সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ সময় দিনের বেলা কমপক্ষে দুই ঘণ্টা ঘুম বা বিশ্রাম এবং রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম আবশ্যক। ঘুমানো বা বিশ্রামের সময় বাঁ-কাত হয়ে শোয়া ভালো। গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস ও শেষ তিন মাস দীর্ঘ ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। উঁচু-নিচু পথ কিংবা ঝাঁকির আশঙ্কা আছে- এমন যানবাহনে ভ্রমণ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সকাল ও বিকালে কিছু সময়ের জন্য স্বাস্থ্যকর ও মনোরম পরিবেশে ভ্রমণ অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য ভালো, এতে শরীর সুস্থ ও মন প্রফুল্ল থাকে। তাই ফুলের বাগান, লেকের পাড়, পার্ক এসব স্থানে ভ্রমণ করা উচিত।

অতিরিক্ত আবেগ, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, ভয়, রোগশোক ইত্যাদি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই এসব এড়িয়ে ভালো চিন্তা করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করা যাবে না। পানিশূন্যতা রোধে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক পরিমাণে পানি পান করতে হবে। সব ধরনের ঝুঁকি এড়াতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।

পরিশেষে বলতে চাই, গর্ভাবস্থায় প্রত্যেক নারীর বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। কারণ, একজন নারী যতবারই গর্ভধারণ করেন ততবারই জটিলতা দেখা দিয়ে তার জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। তাই গর্ভধারণ করলে নারীর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের উচিত তার শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়া ও প্রসবের জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করা।

এফএ
আর্কাইভ