রেজাউল মাসুদ
গ্রেফতার হলেন মো. কায়েস। সঙ্গে তার স্ত্রী শহিদা খাতুনও। তাদের দেয়া তথ্যে সুজন মাঝি নামে আরও একজন আটক হয় সিআইডির সাইবার টিমের হাতে। এরা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘অ্যাকাউন্ট হোল্ডার’ সংগ্রহ করতো। এ ছাড়াও বিভিন্ন নামে অ্যাকাউন্ট খুলে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু প্রতারক নাইজেরিয়ানদের সরবরাহ করতো। কায়েসের নিজের নামে এ ধরনের ১৫টি অ্যাকাউন্ট ও অন্যান্য নামে আরও ৩৩টি অ্যাকাউন্ট পেয়েছে সাইবার ইউনিট। গত ২০১৮ সাল থেকেই এ কাজ করে যাচ্ছিলেন তিনি। এ কাজে তাকে সহায়তা করতেন অনেকে, কায়েসের মতো এমন অন্তত চল্লিশটি টিম রয়েছে।
অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তিদের বোঝাতেন যে, অনেক ব্যবসায়িক লেনদেন হয় বিধায় তার নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা আসলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজরদারী কিংবা লক করে দিতে পারেন। তাই মাঝে-মাঝে তাদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করবেন। যে পরিমান টাকা আসবে তার ৫ শতাংশ অর্থ্যাৎ প্রতি লাখে ৫০০০ টাকা অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তি পাবেন। প্রতি মাসে কায়েসের এভাবে গড়ে ৩০/৪০ হাজার আয় হতো। কেউ রাজি হলেই অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের কাছে থেকে বিভিন্ন সময়ে স্বাক্ষরিত চেক বই নিজের সংগ্রহে রাখতেন কায়েস।
তিনটি ধাপের মাঝেরটি করতো তুর্ণার মতো ভদ্রবেশী ক্রিমিনালরা। সুন্দর করে কথা বলতো- ‘হ্যালো, আমি কাস্টমস কর্মকর্তা ফারজানা মহিউদ্দিন তুর্ণা ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বলছি। বিদেশ থেকে আপনার নামে একটি পার্সেল এসেছে।’
এভাবেই শুরু হয় তুর্ণার বক্তব্য। তবে ধীরে ধীরে আসে নানা জটিলতার কথা পার্সেলটির জন্য ‘কাস্টমস ফি’ হিসেবে আপনাকে একটা অঙ্কের টাকা দিতে হবে। একটু পর আবারও ফোন করে বলেন, ‘পার্সেলে অবৈধ স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। এগুলো বৈধ করার জন্য ফি দিতে হবে, নইলে মানি লন্ডারিং আইনে আপনি মামলায় পড়বেন।’
চট্টগ্রামের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাসখানেক আগে ঢাকায় এসে আমাকে জানায় তার একটা ভিআইপি পার্সেল এসেছে আফগানিস্তান থেকে। এয়ারপোর্টের কাস্টমস অফিসার আজ ফোন দিয়েছে তাকে। ঢাকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিবে বলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফোন- ভিতরে ভ্যালুয়েবল জিনিস রয়েছে, কাস্টমস ফি বাবদ তাকে ৪৭ হাজার টাকা শোধ করতে হবে। দুবার দুটো নম্বর থেকে ফোন। আমি তাকে নিশ্চিতভাবে জানাই এ কাজ প্রতারকদের। ফোন দুটোর লোকেশন জেনে দেখি একটা গাজীপুর আরেকটা নারায়নগঞ্জ। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করলে আমার কথামতো বন্ধুটি কাস্টমস কর্মকর্তাকে নিজে পরিশোধ করে প্যাকেটটি বাসায় পাঠাতে বলে। বাসায় এলে বখশিসসহ টাকা দিবে বলে জানায়। এরপর তারা আমার বন্ধুটিকে ভয় দেখায়। র্যাবের ডিজি স্যারের আইডি কার্ড পাঠায়। বলে টাকা পরিশোধ না করলে আপনার নামে এক্ষুণি মামলা হবে। পরে মামলাও হয়নি, আর ফোনও করেনি।
চট্টগ্রামের বন্ধুটি নিশ্চিতভাবে প্রতারণা থেকে বেঁচে গেলেও ঢাকার এক পরিচিত বড় ভাইকে বাঁচাতে পারিনি। তিনি যখন আমার স্বরণাপন্ন হলেন তখন তার কাছ থেকে ফারজানা তুর্নারা অলরেডি সাড়ে ছয় লাখ টাকা নিয়ে নিছে। আরও টাকা নেয়ার জন্য নানা প্রলোভন ও ভয় দেখাচ্ছে।
গল্প একই, চরিত্রও একই ধাচের। ফেসবুক একাউন্টে বিদেশি মহিলা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর পরে বন্ধু তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করি। দ্রুত আমাদের মাঝে একটি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে আফগানিস্তান মিশনে আমেরিকান সেনাবাহিনীর সদস্য বলে আমাকে পরিচয় দেয়। আফগানিস্তানে তাদের কী কাজ, কী অভিযান করে, প্রায়ই এমন ছবি ভিডিও পাঠায়। আমার পরিবারের কথা আগ্রহ ভরে জানতে চায়। এমতাবস্থায় মাসখানেকের মধ্যে একদিন সে আমাকে একটি উপহার বক্স পাঠানোর প্রস্তাব দিলে আমি বন্ধুত্বের খাতিরে রাজি হই।
কিছুদিন পর শুল্ক কর্মকর্তা পরিচয়ে আমাকে ফোন করে বলা হয়, বিদেশি বন্ধুর পাঠানো ওই উপহার দেশের নিয়ম অনুযায়ী শুল্ক পরিশোধ না করে আনা হয়েছে। তাই শুল্ক হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিতে বলা হয়। গিফটের ছবি ডেলিভারি চালানের কপি কাস্টমস কর্মকর্তা আমার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায় যেটা আমার আমেরিকান বন্ধুর দেয়া কপির সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
কাস্টমস ডেলিভারি ফি হিসাবে আমাকে ৫০ হাজার টাকা একটি ব্যাংক একাউন্টে জমা দিতে বলায় আমি সেটা জমা করি। আমেরিকান বন্ধুকে জানালে সে বলে- ‘তোমার দেশের কাস্টমস ডিউটি তো দিতে হবে। তুমি দিয়ে আমার গিফটটা নিয়ে নাও।’
আমাকে দ্বিতীয়বার ফোন করে বলা হয়, উপহারের বাক্সে কিছু ডলার বা অন্য কোনো বিদেশি মুদ্রা রয়েছে। সেজন্য আরও টাকা দিতে হবে। না হলে শুল্ক আইন ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে। আমি পরে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিই। কাস্টমস থেকে তারা বিভিন্নভাবে আমাকে বুঝায় বাংলাদেশি হিসাবে বহু টাকা এখানে। পেতে হলে নিয়মমতো পরিশোধ না করলে আপনি বড় ঝামেলায় ফেঁসে যাবেন। তাদের ভয়, প্রলোভন আর আমার লোভে আমি চার বারে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দেই।
এ চক্রটি এসব প্রতারণা করেই যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। মাসে এভাবে বিভিন্ন জনের কাছে ৪০/৫০ লাখ টাকা নিয়ে যাচ্ছে এ চক্র। যদিও গত এক মাসে সিআইডি ৩৫ জন নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করেছে। যারা ফেসবুকে প্রথম টার্গেট করে বন্ধু করে। এ ছাড়া কাস্টমস কিংবা কুরিয়ার কর্মকর্তা সেজে ফোন করা এমন তিনজন বাংলাদেশি আর ব্যাংকিং ট্রানজেকশন কাজ করার জন্য সর্বশেষ কায়েসদের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে সাইবার টিম।
সচেতন হোন, সতর্ক থাকুন। প্রয়োজনে সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের সহায়তা নিন।
ফেসবুক পেজ- https://www.facebook.com/cpccidbdpolice/
২৪/৭ কন্টাক্ট নম্বর- ৯৯৯ অথবা +৮৮ ০১৩২০০১০১৪৮
লেখক : স্পেশাল সুপারিডেন্টেন্ট অব পুলিশ, সাইবার পুলিশ সেন্টার, সিআইডি।
সবুজ/নির্জন
ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন