• ঢাকা বৃহস্পতিবার
    ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী গুড়ের বাজার

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৩, ০৬:০২ পিএম

চুয়াডাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী গুড়ের বাজার

ফিচার ডেস্ক

দেশশজুড়ে চুয়াডাঙ্গার খেজুরের গুড় ও নলেন পাটালির সুখ্যাতি রয়েছে। এই গুড় স্বাদে-গন্ধেও অতুলনীয়। বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে এখন জমজমাট ঐতিহ্যবাহী সরোজগঞ্জ হাট। হাটের দিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ব্যাপারীসহ হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতা।

চুয়াডাঙ্গা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে কুতুবপুর ইউনিয়নের সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে শীত মৌসুমে সপ্তাহে দুই দিন সোম ও শুক্রবার এই গুড়ের হাট বসে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। এরপর ছোট-বড় ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে সারা দেশে পৌঁছে যায়।

প্রতি সপ্তাহে প্রায় কয়েক কোটি টাকার গুড় কেনাবেচা হয়।

জমে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী খেজুর গুড়ের হাট সরোজগঞ্জ বাজার। বাজারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সারি সারি সাজানো গুড়ের ভাঁড়। প্রতিবছর শীত মৌসুমে সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেজুর গুড়ের বেচাকেনা হয় এ হাটে। 

স্বাদে ও গন্ধে এখানকার গুড় অতুলনীয়। মৌসুমের প্রায় পুরো সময়জুড়েই হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে জমজমাট থাকে এই হাট। স্থানীয় পাইকার, মহাজন এবং বিভিন্ন মোকাম থেকে আসা ব্যাপারীরা এমনটাই দাবি করেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ২ লাখ ৬০ হাজারের মতো খেজুরগাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে এক মৌসুমে অন্তত ১২-১৪ কেজি গুড় পাওয়া যায়। সে হিসাবে জেলায় তিন হাজার মেট্রিক টন গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। 

প্রতি মেট্রিক টন ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ওই হিসাব অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ২৪ থেকে ২৫ কোটি টাকার খেজুর গুড় বিক্রি হবে এই হাটে।

সরেজমিনে সোমবার সকাল ১০টার দিকে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে কৃষকেরা গুড়ভর্তি মাটির কলস (ভাঁড়) ও বেতের তৈরি পাত্র (ধামায়) করে নলেন টালি নিয়ে বসে আছেন। বাতাসে ভেসে আসছে মিষ্টি একটা গন্ধ। ক্রেতারা হাতে থাকা লোহার শিক দিয়ে গুড় ও পাটালি ভেঙে মুখে পুরে পরীক্ষা করছেন। 

দরদাম ঠিক হলেই গুড়ের কলসগুলো মাঠের এক পাশে সাজানো হচ্ছে। প্রতিটি কলসের গায়ে সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া হচ্ছে, যাতে পরে দ্রুত খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাপারীদের পাশাপাশি অনেকেই নিজের পরিবার ও স্বজনদের বাড়িতে পাঠাতে গুড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ১২-১৩ কেজি ওজনের প্রতিটি কলস ১৭০০-১৮০০ টাকা এবং ১৫-১৬ কেজি ওজনের কলস ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নলেন পাটালি প্রতি কেজি ২৪০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

ক্রেতাদের দাবি, মৌসুমের শুরুর দিকে অসাধু কিছু লোক গুড়ে চিনি মিশিয়ে বিক্রির পাঁয়তারা করেন। তবে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে তা বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া গুড়ের দাম কমে যাওয়া ও চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় যারা এমনটা করতেন, তারাও তা বন্ধ করে দিয়েছেন।

মাটির হাড়ির বা ভাঁড়ের আকার ও ওজন ভেদে দাম ওঠানামা করে। অন্যান্য বারের তুলনায় এখানকার খেজুর গুড়ের চাহিদা বেশি থাকায় দামও বাড়ছে।

রাজবাড়ীর ব্যাপারী সাইফুল ইসলাম জানান, বাবার সঙ্গে ৪০ বছর আগে থেকে এ হাটে গুড় কিনতে আসি। আজও কিনে যাচ্ছি। এখানকার গুড়ের বেশ সুনাম আছে। তাই লাভও  বেশি হয়। 

সিরাজগঞ্জের বেলকুচির ব্যাপারী আজগর আলি জানান, ৩৫ বছর থেকে এই হাটে গুড়ের ব্যবসা করছি। প্রতি হাটে ১০০ থেকে দেড়শ’ ভাঁড় গুড় কিনে থাকি। তার মতো অসংখ্য ব্যাপারী নিয়মিত গুড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের রইসের সাঙ্গে হাটের দিন কথা হয়। তিনি  জানান, ৮ ভাঁড় গুড় এনেছিলাম ভালো দামে বিক্রি করেছি। গুড় বিক্রি নিয়ে কোনো প্রকার ভোগান্তি হয় না। গুড় হাটে আনার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যায়।

বাজারের ব্যবসায়ী আজিজুল হক জানান, এখান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, পাবনাসহ দেশের বড় বড় মোকামে গুড় যায়। প্রতি হাটের দিন গড়ে ২৫০ টন খেজুর গুড় বিক্রি হয়। যার বিক্রয় মূল্য প্রায় কয়েক কোটি টাকা। এই মৌসুমে হাটে হাজারো মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

কুতুবপুর ইউনিয়নের সাহেব নগর গ্রামের গুড়ের ক্রেতা মোঃ কুতুবউদ্দিন জানান, এই সরোজগঞ্জ বাজারে বহুদিন ধরে গুড় কিনে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে থাকি। যেমন ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা,পঞ্চগড়,দিনাজপুর,ফরিদপুর, টেকের হাটসহ বিদেশেও রপ্তানি করে থাকি।

সরোজগঞ্জ গুড়ে হাটের শ্রমিকের সর্দ্দার খাইবার আলী বলেন, আমরা ব্যাপারীদের গুড় টানার কাজ করি ও ট্রাকে গুড় লোড করি। সরোজগঞ্জ বাজারে প্রতি হাটে আয় হয় ৮০০-৯০০ টাকা মত। এ কাজ করে সংসার ভালই চলছে।

স্থানীয় বাজার কমিটির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান আলী আহাম্মেদ হাসানুজ্জামান মানিক দাবি করেন, চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় খেজুর গুড়ের হাট সরোজগঞ্জ। মৌসুমে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস হাটের দিন ১৫০ থেকে ১৭৫ টন পরিমাণ খেজুর গুড় ও পাটালি বেচাকেনা হয়। যার বিক্রয়মূল্য কোটি টাকার ওপরে। 

তিনি বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বরিশালসহ দেশের বড় বড় মোকাম থেকে ব্যাপারীরা এখানে গুড় কিনতে আসেন। এছাড়া এলাকার মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও গুড় কিনে সারা দেশে সরবরাহ করে থাকেন।

 

সাজেদ/

আর্কাইভ