প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২৩, ১২:০৪ এএম
সিলেটকে অনায়াসেই টক ফলের দেশ বলা যেতে পারে। সিলেট বিভাগে যে পরিমানে সাইট্রাস জাতিয় ফল উৎপন্ন হয় তাতে এই অভিধায় শ্রীভূমিকে আখ্যায়িত করলে অত্যুক্তি হবেনা। সিলেটের কমলা ও লেবুর স্বাদ আস্বাদন করেন নি এমন লোক হয়তো খোঁজে পাওয়া যাবে না। সাতকরা, লিচু, লটকন, লুকলুকি, তৈকর, জাম্বুরা এবং মাল্টার জন্য প্রসিদ্ধ সিলেটে যেনো টক ফলের ছড়াছড়ি। একসময় পাহাড়ি এলাকা, বাড়ির আঙিনা এবং পতিত জমিতে এইসব টকফল উৎপাদিত হলেও চাহিদা বৃদ্ধির কারনে এখন এসব ফল বানিজ্যিকভাবে উৎপন্ন হচ্ছে। দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এসব ফল রপ্তানী হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যা থেকে প্রতিবছর আসছে বিপুল পরিমানের বৈদেশিক মুদ্রা। এতে করে উৎপাদনকারীরা যেমন সচ্ছল হচ্ছেন তেমনি অর্থনীতির চাকাও হচ্ছে গতিশীল।
সাতকরা
সিলেটে এসে সাতকরার স্বাদ আস্বাদন করেননি এমন ভ্রমনার্থী খুজে পাওয়া যাবে না। সিলেট অঞ্চলের মানুষের কাছে রসনার অন্যতম অনুসঙ্গ এই সাতকরা। হরেক রকমের খাবার তৈরী করা যায় সাতকরা দিয়ে। মাংস মাছ এবং ডালের সাথে সাতকরা দিয়ে তৈরী করা খাবার এতটাই সু-স্বাদু যে একবার খেলে তার স্বাদ ভোলা যায় না। সাতকরার আচার খুবই মজাদার।
স্বাদে গন্ধে অনন্য সাতকরা মুখরোচক সবজি হিসেবে সিলেটের সর্বত্র সমাদৃত। হালকা টক ও তেঁতো সাতকরা মাছ, মাংস ও ডালের সাথে রান্নায় ভিন্ন মাত্রা তৈরী করে। ধনিয়া পাতা ছাড়া যেমন রাধুনীরা ভাল রান্না চিন্তা করেন না তেমনি সিলেটের নারীরা সাতকরা ছাড়া মাংস কিংবা ইলিশ রান্নার কথা ভাবেন না। সাইট্রাস ফ্রুট হিসেবে বিভিন্ন দেশে রপ্তানী করা হয় কাঁচা সাতকরা। প্রবাসী সিলেটীদের জন্য সাতকরা কেটে শুকিয়ে প্যাকেট করে পাঠানো হয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাস্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। কোরবাণী ঈদে সাতকরার চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের জাফলং বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ছাতক, বড়লেখা, কোম্পানীগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ প্রভৃতি স্থান ছাড়াও সিলেট অঞ্চলের পাহাড়-টিলায় সাতকরার চাষ হয়। ফাল্গুন মাসে ফুল আসে সাতকরা গাছে। সেই ফল পরিপক্ষ হয় জৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে। লেবুগাছের মতো সাতকরার কাঁটাভরা গাছ ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়। কমলা চাষের মতো নিবিচ্ছিন্ন কোনো চাষপদ্ধতি না থাকায় সাতকরার উৎপাদনসংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে নেই।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, সারা বছর সাতকরা পাওয়া গেলেও বর্তমানে মৌসুম হওয়ার কারনে টাটকা সাতকরা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। লেবুজাতীয় এ ফল ভারতের আসামের পাহাড়ি এলাকার আদি ফল। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সিলেটীদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা থাকায় সেখানেও এটি রফতানি হয়। ইদানীং সিলেটের বাইরের জেলাগুলোতেও সাতকরার চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
দিন দিন সাতকরার চাহিদা বাড়ছে। শুধু সিলেটেই নয়, সারা দেশে এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও রফতানি হচ্ছে সিলেটের সাইট্রাস জাতিয় এই ফল। কিন্তু সাতকরার চাহিদা যে হারে বাড়ছে, ঠিক সেই হারে উৎপাদন বাড়ছে না। ব্যক্তির প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এর উৎপাদন। অথচ সঠিক চাষ পদ্ধতির আওতায় নিয়ে এসে বানিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন করা হলে সাতকরা রফতানি করে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হতো।
কমলা
কমলার দেশ সিলেট। কমলার জন্য এক সময় সিলেটের সুখ্যাতি ছিল সর্বত্র। খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে উৎপাদিত এ কমলার পরিচিতি ছিল ‘খাসিয়া জাত’ হিসাবে। আকার আকৃতি ও রসের জন্য বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত কমলার চাহিদা ছিল সীমান্তের ওপারেও। এক সময় এ অঞ্চলের চাষীদের অন্যতম অর্থকরী ফসল ছিল কমলা। এখানকার উৎপাদিত কমলা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। কিন্তু ষাটের দশকের শুরুতে এতে ছন্দপতন ঘটে। হঠাৎই কমলা বাগানে দেখা দেয় ক্ষয়িঞ্চু ‘ডিক্লাইন ডিজিজ’। এ মড়কে অধিকাংশ কমলা বাগান বিনষ্ট হয়ে যায়। এই মড়কের ক্ষতি পোষাতে না পেরে অনেক কমলা চাষী কমলা চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। মাটির পুষ্টিমান ক্ষয়ে যাওয়া, রোগ বালাইর উপদ্রব, গাছের উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও মড়ক ইত্যাদির কারণে ধীরে ধীরে কমলার উৎপাদন মারাত্বকভাবে হ্রাস পেতে থাকে এবং এক সময় সিলেটের কমলালেবু স্বকীয়তা হারায়। তবে নব্বই দশকের শুরুতে সিলেটের বড়লেখা উপজেলার কৃষকরা কমলা চাষ করে ভালো ফলন পেলে পুনরায় কমলা চাষীদের ভিতর জাগরণ সৃষ্টি হয়। সময়ের সাথে সাথে তা সম্প্রসারিত হতে থাকে।
সিলেটের অতীত ঐতিহ্য রক্ষায় এবং দেশে কমলার চাহিদা পূরণে ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ‘বৃহত্তর সিলেটে কমলা ও আনারস উন্নয়নসহ সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে। সে সময় জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের কচুরগুল ও হায়াছড়া এলাকায় ৬৯ হেক্টর জমি নিয়ে কমলা চাষ প্রকল্পের যাত্রা শু্রু হয়। পরবর্তীতে আরও ৫৫ হেক্টর জমিতে তা সম্প্রসারিত হয়। চাষীরা নিজ উদ্যোগে অতিরিক্ত ৪৫ হেক্টর জমিতে কমলা চাষ করেন। এরপর সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় পূর্বের ন্যায় শুরু হয় কমলা চাষ। কমলা চাষে একদিকে যেমন কৃষকরা স্বাবলম্বি হতে থাকে অন্যদিকে কমলা রপ্তানির মাধ্যমে প্রতিবছর অর্জিত হচ্ছে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা।
কৃষি সম্পসারণ অধিদফতর সূত্র অনুযায়ি, শুধুমাত্র মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার চাষীরা প্রতি বছর প্রায় কোটি টাকার কমলা বিক্রি করে থাকেন। উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের হায়াছড়া, নালপুঞ্জি, ডোমাবাড়ি, উত্তর কুচাই, দক্ষিণ কুচাই, শুকনাছড়া, রূপাছড়া, জড়িছড়া, ইসলামাবাদ, বেলবাড়ি, লাঠিটিলা, কছুরগুল, গোয়ালবাড়ি, জামখান্দি, গুলসা, বোবারথল, কাঁঠালতলি প্রভৃতি এলাকায় কমলার চাষ হয়। সিলেট বিভাগের চাষীরা প্রতি মৌসুমে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার কমলা কেনাবেচা করে থাকেন। তবে উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধির ওপর এ টাকার অঙ্কেও তারতম্য ঘটে।
কমলা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. সুবোধ চন্দ্র জানান, সিলেটের কমলাচাষীরা অনেকটা অপরিপক্ব অবস্থায়ই কমলা বিক্রি করে ফেলেন। পরিপক্ব হওয়ার পর বিক্রি করলে তারা আরও লাভবান হতে পারতেন।
জুড়ীর কমলা চাষী নজরুল জানান, ‘কমলা সিলেটের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। এটি আমাদের নিজেদের ফসল।
লটকন
লটকন এক প্রকার টক মিষ্টি ফল। সিলেটে এর পরিচিতি ‘ভুবি’ হিসেবে। সিলেট অঞ্চলে প্রচুর পরিমান লটকন উৎপাদিত হয়। লটকন বৃক্ষ ৯-১২ মিটার লম্বা হয়, এর কান্ড বেটে এবং উপরাংশ ঝোপালো। পুং এবং স্ত্রী গাছ আলাদা। হলুদ রঙের এই ফলের আকার দুই থেকে পাঁচ সেমি, যা থোকায় থোকায় ধরে। ফলে ২-৫ টি বীজ হয়, বীজের গায়ে লাগানো রসালো ভক্ষ্য অংশ থাকে, যা জাতভেদে টক বা টকমিষ্টি স্বাদের। এই ফল সরাসরি খাওয়া যায় বা জ্যাম তৈরি করে ব্যবহৃত হয় রসনায়। ছায়াযুক্ত স্থানেই এটি ভাল জন্মে।
লটকনের বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে; যেমন- ডুবি, কানাইজু, লটকা, লটকাউ ইত্যাদি। বাংলাদেশে একসময় অপ্রচলিত ফলের তালিকায় ছিল লটকন। অধুনা এর বানিজ্যিক উৎপাদন ব্যাপক আকারে হচ্ছে। উন্নত জাতের সুমিষ্ট লটকনের চাষ বৃদ্ধির সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তাও বেড়ছে।
লটকনের পুষ্টিমান প্রচুর। এই ফলে প্রচুর পরিমানে রয়েছে ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। লটকনের ভেষজগুণও রয়েছে। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ ও বমনের ভাব দূর করতে কার্যকর। শুকনো পাতার গুঁড়ো সেবনে ডায়রিয়া নিরাময় ও মানসিক চাপ কমে।
লুকলুকি
লুকলুকি। সিলেটের আরও একটি টক ফল। পাকলে এর রং লালচে বেগুনী হয়ে যায়। ফলের অভ্যন্তরভাগে শাঁসের রং গোলাপী সাদা বা হালকা বাদামী। খোসাসহ পুরো ফল খাওয়া যায়। ফলটির পূর্ণ স্বাদ পেতে খাওয়ার আগে এটি টিপে তুলতুলে করে খেতে হয়। লুকলুকি দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।
লুকলুকির ইংরেজি নাম ‘কফি প্লান্ট`। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ফ্লাকোর্টিয়া জ্যাংগমাস’। আমাদের দেশে উৎপাদিত লুকলুকির তিনটি জাত হলো- ‘জ্যাংগমাস`, ‘ক্যাটাফ্রক্টা` ও ‘দেশী`। লুকলুকি দিয়ে ভালো জুস তৈরী করা যায়। কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় তার ‘বাংলার বিচিত্র ফল` গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, লুকলুকির গাছটা বড় অদ্ভূত চরিত্রের। ওর গোড়া থেকে মোটা কান্ডের সারা গা ভরে থাকে বড় বড় তন্মী কাঁটা। এর কাঁটাগুলো শাখায়তি, যুথবদ্ধ। তাই কান্ড বেয়ে গাছে ওঠা ও ফল পাড়ার কথা কেউ চিন্তাই করে না। লুকলুকির গাছ খাটো থেকে মাঝারি আকারের বৃক্ষ। উচ্চতায় ৪-৫ মিটার হয়। ডালপালাও কাঁটাপূর্ণ।
পাতা একক, ডিম্বাকৃতি, তবে কিছুটা লম্বাটে গড়নের। অগ্রভাগ সূঁচালো। সবুজ রংয়ের পাতা কিছুটা ঢেউ খেলানো। মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে। মুদ্রাকৃতির বেগুনী রংয়ের ফুল ফোটে গু”ছাকারে, ছড়ায়। ফল গোলাকার মার্বেলের মতো, খোসা খুব পাতলা ও মসৃণ। ফল পরিপক্ব হয় জুলাই-আগস্ট মাসে।
তৈকর
তৈকর সিলেট অঞ্চলের জনপ্রিয় আদি টক ফল। সিলেটের পাহাড়ি এলাকার নিকাশযুক্ত অম্লীয় মাটিতে তৈকর উৎপাদিত হয় প্রচুর পরিমানে। কেউ কেউ তৈকরকে থৈকোলও বলে থাকে। কাঁচা অবস্থায় ফলের রং গাঢ় সবুজ, পাকলে হয় হলদে। তৈকর গাছে বছরে দু’বার ফল আসে। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৩০০-৩৫০। প্রতি ফলের ওজন ৭০০-৭৫০ গ্রাম। তৈকর স্কার্ভি রোগ নিরাময়ে কাজ করে। তৈকরের তৈরী আচার, জ্যাম, জেলি খুবই মজাদার।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বনায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিউল আহসান তালুকদার জানান, তৈকর বা থৈকোল ভারতের আসামের একটি আদি ফল। সিলেট অঞ্চল আসামের পাশাপাশি হওয়ায় ফলটি এখানে পাওয়া যায়। উঁচু টিলায় এ ফল ভালো হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করলে লাভবান হওয়া সম্ভব।
জাম্বুরা
জাম্বুরা লেবু প্রজাতির এক প্রকার ফল। বাংলায় এর অপর নাম ‘বাতাবী লেবু’। বিভিন্ন ভাষায় এটি পুমেলো, জাবং, বা শ্যাডক নামেও পরিচিত। এর কোয়াগুলোও লেবুর কোয়ার মত, তবে পাকা জাম্বুরার কোয়ার রঙ গোলাপী। জাম্বুরার খোসা অনেক পুরু হয় এবং খোসার ভিতর দিকটা ফোম এর মত নরম। এটি ভিটামিন সমদ্ধ ফল।
সিলেটের মাটি ও আবহাওয়া জাম্বুরা চাষের উপযোগী। সিলেটে এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না যে বাড়িতে জাম্বুরা গাছ নেই। ফাগ্লুন মাসে জাম্বুরা গাছে ফুল আসে। আর পাকে ভাদ্র আশ্বিন মাসে। সিলেটের বাজারগুলোতে জাম্বুরা পাওয়া যায় প্রচুর পরিমানে।
মাল্টা
সিলেটের পাহাড়ী এলাকায় দিন দিন মাল্টার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেখতে ও খেতে অনেকটা কমলার মতো মাল্টা। মাল্টার রস দিয়ে, জ্যাম, জেলি তৈরী করা যায়। ৬-৭ বছর বয়সি প্রতিটি মাল্টা গাছ থেকে প্রতি বছর ২৫০-৩০০ টি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। আমাদের দেশের সবচেয়ে উপযোগি মাল্টার উন্নত জাতের নাম ‘বারি মাল্টা-১’।
বীজ এবং কলম থেকে এর বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। সরকারি হর্টিকালচার সেন্টার থেকে এর চারা সংগ্রহ করে তা রোপন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে মাল্টার বাগান গড়ে তুলা যায়। সিলেটের জৈন্তাপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় মাল্টার চাষ হচ্ছে। বছরের প্রায় বারো মাসই মাল্টা পাওয়া যায়। সংরক্ষণও করা যায় দীর্ঘদিন।
লেবু
লেবু উৎপাদনে সিলেটের তুলনা নেই। শুধুমাত্র বিভাগের শ্রীমঙ্গল উপজেলাতেই উৎপাদিত হয় দেশের লেবুর চাহিদার শতকরা ৭৫ শতাংশ।
আদিকাল থেকে শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির লেবুর চাষ হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ শুরু হয় সত্তরের দশকে। লাভজনক হওয়ার কারনে কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, বড়লেখা ও হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল এবং চুনারুঘাট উপজেলায় লেবু চাষ শুরু হয়। এই অঞ্চলে উৎপাদিত লেবুর অধিকাংশই কাগজি লেবু।
মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় বর্তমানে ২৫ হাজার হেক্টর পাহাড়ি ও সমতলভূমিতে কাগজি লেবুর চাষাবাদ হচ্ছে। এরমধ্যে শ্রীমঙ্গলের ৯শত ৯০ হেক্টর জমিতে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার টন কাঁচা লেবু উৎপাদিত হচ্ছে।
মৌলভীবাজার জেলার সাত উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে লেবু বাগান রয়েছে প্রায় ৩ হাজার। যার সঙ্গে মালিক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী মিলিয়ে প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক লোক সম্পৃক্ত। প্রতি বছর শুধুমাত্র শ্রীমঙ্গলে অর্ধশত কোটি টাকার কাগজি লেবু বেচাকেনা হচ্ছে। এখানকার লেবু যাচ্ছে বিদেশেও। লেবুচাষকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে লেবু প্রক্রিয়াজাত কারখানা স্থাপন করে লেমন জুস, সিরাপ, সাইট্রিক এসিড, আচারসহ নানা ধরনের ভোগ্যপণ্য উৎপাদন সম্ভব।
লেবু চাষকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সেচ সমস্যা, লেবু চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন, বিক্রির জন্য বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন ও চাষিদের কৃষি প্রযুক্তির আওতায় আনতে হবে। এতেকরে একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে তেমনি অন্যদিকে লেবু রপ্তানী করে বিপুল পরিমান রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।
এবং সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র,
সিলেট অঞ্চলের প্রকৃতি পরিবেশ এবং সাইট্রাস জাতিয় ফলের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে জৈন্তাপুর উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় ১১৮.৬৪ একর জমির উপর ১৯৬১ সালে স্থাপন করা হয় সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিষ্টিটিউট’র একমাত্র লেবু জাতীয় ফলের গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের লেবু জাতীয় ফসল যেমন কমলা, মালটা, সাতকরা, তইকর, বাতাবি লেবু সহ অন্যান্য লেবু ফসলের উন্নত জাতের উদ্ভাবন, উদ্ভাবিত জাতের উৎপাদন প্রযুক্তি, রোগ ও পোকার আক্রমন থেকে ফল ফসলের রক্ষা করা, ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষনের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নত জাতের চারা কলম সরবরাহ প্রতৃতি বিষয়ে গবেষণা ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। তবে কেন্দ্রটি পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় আধুনিক সেচ সুবিধার অভাবে ফলন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আধুনিক সেচ সুবিধা ও উন্নতমানের কৃষি যন্ত্রপাতি থাকলে সহজেই এই কেন্দ্র থেকে নতুন নতুন ও উন্নতমানের মাল্টা, কমলা, সাতকরা, জামরুল, কাঁঠাল, বাতাবি লেবুসহ সাইট্রাস গোত্রের ফলের আরো কয়েকটি জাত অচিরেই উদ্ভাবন করা সম্ভব হবে।
এ কেন্দ্রে ঔষুধি বৃক্ষের প্রায় ২৫ ধরনের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কেন্দ্রটির উদ্যোগে প্রায় প্রতি বছরই কৃষক প্রশিক্ষণ, মাঠ দিবস, চাষাবাদ বিষয়ে পরামর্শ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রধান কার্যালয় থেকে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী ও এ কেন্দ্রের বিজ্ঞানিগণ সরাসরি কৃষকদের প্রশিক্ষণ দান করেন এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। শুরুথেকেই এ কেন্দ্র থেকে ফলের নতুন নতুন জাত নির্বাচন এবং এগুলোর আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তির উপর কাজ করে আসছে। কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট সকলের নিরলস প্রচেষ্টার ফলের ৪টি ও মসলার ১টি জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের বহুল আলোচিত ও পরীক্ষিত জাতসমূহের মধ্যে জৈন্তা গুলমরিচ-বারি তৈকর-১, বারি কমলা-১, বারি সাতকরা-১, বারি মালটা-১ উলেখযোগ্য।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, তারা এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময়ে হাতে-করমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং কেন্দ্র থেকে উন্নতমানের চারা নিয়ে বাগান স্থাপন করেছেন। এর ফলে এখন বাগান পোকার আক্রমণ থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকছে। এবং ফলও থাকছে ক্যাংকারস মুক্ত। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাইট্রাসগোত্রের ফল রপ্তানীতে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মোখিন হতে হচ্ছে না। প্রতিবছর সাইট্রাস জাতিয় ফল রপ্তানী করে আয় করা হচ্ছে বিপুল পরিমানের রাজস্ব।
জৈন্তাপুর সাইট্রাস গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. লুৎফুর রহমান জানান, জৈন্তাপুর সহ সিলেটের পাহাড়ি এলঅকাগুলোতে সাইট্রাস গোত্রের ফলে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তারা এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারবে। তিনি বলেন, গবেষনা কেন্দ্রে দীর্ঘদিন ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা ছিল, তা উচ্চ আদালতের রায়ে নিরসন হয়েছে। যার ফলে উন্মোচিত হয়েছে বিপুল সম্ভাবনা দ্বার। এখন চাইলে এখানে অনেক কিছু করার সুযোগ আছে।
সাজেদ/