প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩, ২০২৩, ১১:০০ পিএম
‘শালা মারবো এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে!’ সংলাপটি নিশ্চয়ই অনেকের মনে গেঁথে আছে। ভারতীয় বাংলা ছবি ‘মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট’র এই সংলাপের দরুন সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী বাঙালির কাছে পরিচিতি পেয়েছেন নতুনভাবে। অনেকের কাছেই মিঠুন এখন মিনিস্টার ফাটাকেষ্ট কিংবা গুণ্ডা ফাটাকেষ্ট নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের বরিশালে জন্ম নেয়া মিঠুন অভিনয় দক্ষতায় কাঁপিয়েছেন টালিগঞ্জ। কলকাতা থেকে মুম্বাই গিয়েও অমিতাভ বচ্চনদের সময়ে হয়েছেন বলিউডের সুপারস্টার। এর বাইরেও অভিনয় করেছেন ভারতীয় বেশ কয়েকটি ভাষার সিনেমায়। বরিশাল থেকে ভারতীয় সুপারস্টার কেমন ছিল তার এই পথচলা? মসৃণ নাকি জটিল? সেসব গল্প তুলে ধরা হলো সিটি নিউজ ঢাকা’র পাঠকদের জন্য।
মিঠুন চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৫২ সালে ১৬ জুন বরিশালে। তার পারিবারিক নাম গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী। কৈশোর এবং শৈশবে অনেকটা সময় বরিশালে কাটিয়েছেন মিঠুন। পড়েছেন বরিশাল জিলা স্কুলেও। সেখান থেকে পারিবারিক কারণেই বাবা বসন্ত কুমার চক্রবর্তী ও মা শান্তি রানী চক্রবর্তীর সঙ্গে কলকাতায় স্থায়ী হন মিঠুন।
কলকাতায় গিয়ে নতুন করে শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। সেখানকার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পরবর্তীতে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে রসায়নে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এর বাইরেও মিঠুন চক্রবর্তী গ্র্যাজুয়েশন করেন ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এফটিআইআই) থেকে।
নকশাল আন্দোলনের কারণে কলকাতা ছেড়ে মিঠুন পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে। সেখানে অর্থকষ্টে পড়ে অভাবে দিন কাটিয়েছেন, থেকেছেন অন্যের বাড়িতেও। কৌতূহলে ভর্তি হন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে। সেখানেই তিনি নজরে পড়েন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের।
সত্তর দশকের শেষের দিকে বলিউডে যখন অমিতাভ বচ্চনের রাজত্ব চলছে। এ সময়ে মৃনাল সেনের হাত ধরেই বলিউডের পা রাখে মধ্যবিত্ত ঘরের বাঙালি ছেলে মিঠুন। এই নির্মাতার ‘মৃগয়া’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালী জগতে নাম লেখালেন মিঠুন। প্রথম সিনেমায় অভিনয় নৈপুণ্যের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন মিঠুন।
সেরা অভিনেতার পুরস্কার অর্জনের পরও বলিউডে নিজের অবস্থান শক্ত করতে অনেকটাই কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল তার। অভিষেকের পর তিনি ‘দো আনজানে’ এবং ‘ফুল খিলে হ্যায় গুলশান গুলশান’ সিনেমা দুটিতে সহচরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু কোনো গুরুত্ব ও সফলতা পাননি।
এই সময়ে স্পট বয় হিসেবেও কাজ করেছেন। বহুদিন প্রধান চরিত্র পাননি, ছোট ছোট চরিত্রেই কাজ করতে থাকেন। টাকার অভাবে বাধ্য হয়েই হাসিমুখে অভিনয় করতেন এই অভিনেতা। কিন্তু দৃঢ়চেতা মিঠুন হাল ছাড়েননি। লক্ষ স্থির রেখে মুখ বুজে পড়ে থাকার কারণেই মিঠুন একদিন হয়ে উঠলেন বলিউড সুপারস্টার।
বলিউডে মিঠুন চক্রবর্তীর প্রথম সফলতা আসে ১৯৭৮ সালে ‘মেরা রক্ষক’ মুক্তির মাধ্যমে। বাঙালি মিঠুনের ক্যারিয়ারের হাওয়া বদল হতে শুরু করল। ‘প্রেম বিবাহ’, ‘ওহ জো হাসিনা’, ‘সুরক্ষা’ সিনেমার কারণে দর্শকদের কাছে নবাগত অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করলেন তিনি।
সত্তর পেরিয়ে এলো আশির দশক। সময় যেন এবার মিঠুনের পক্ষে, দশকটাই হলো ‘মিঠুন দশক’। মিঠুনকে আর স্পটবয় হয়ে অন্য অভিনেতাদের ব্যাগ টেনে বেড়াতে হয় না। ‘ডিসকো ড্যান্সার’ সিনেমা দিয়ে তিনি বলিউডে নাচের জগতে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন, হয়ে যান সেই দশকের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে যায় মিঠুনের জনপ্রিয়তা। ওই সময়ে নাকি কাজাখস্তানে এয়ারপোর্টে নামার পর মিঠুনকে দেখার জন্য কয়েক লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল! সেইদিন কাজাখস্তানের রাষ্ট্রপতির সভাও নাকি বাতিল হয় হয়েছিল মিঠুনের আগমনে।
নিজের একাগ্রতা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসই মিঠুনকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিল। ক্যারিয়ারে রয়েছে ‘গুন্ডা’, ‘কালিয়া’, কর্মযুদ্ধ’, ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’, ‘অগ্নিপথ’, ‘জল্লাদ’, ‘হাম পাঁচ’র মতো জনপ্রিয় ছবি। বহু পুরুষের স্বপ্নের নায়িকা সুপারস্টার শ্রীদেবী হৃদয় সমর্পিত করেছিলেন মিঠুনের কাছে। যদিও সেই সম্পর্কের সুন্দর সমাপ্তি ঘটেনি।
নব্বই দশকে খল চরিত্রেও অভিনয় করেছেন মিঠুন। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ছবি দিয়ে সেরা সহ-অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। অগ্নিপথ ও জল্লাদের জন্য পান সেরা পার্শ্ব ও খল অভিনেতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। কাজ করেছেন বলিউডে চরিত্রাভিনেতা হিসেবেও। চরিত্রাভিনেতা হিসেবে হাউজফুল ২, বীর, গুরু, ওমাইগড, কিক, হাওয়াইজাদাসহ বেশ কিছু সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা গেছে এই অভিনেতাকে।
বাঙালিদের কাছে মিঠুন জনপ্রিয়তা পান বারুদ, রাজা বাবু, গুরু, তুলকালাম, যুদ্ধ, ছবিগুলো দিয়ে। বাংলায় মিঠুনকে পরিণত অভিনেতা বানানো ছবিগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘তাহাদের কথা’ সিনেমাটি। এতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৯২ সালে জাতীয় পুরস্কারও অর্জন করেন তিনি।
এছাড়া ত্রয়ী, কালপুরুষ, তিতলি, শুকনো লংকা, আমি সুভাষ বলছি, নোবেল চোর, এক নদীর গল্প, নকশাল ছবিগুলোতে অভিনয় করে তিনি হয়েছেন বাংলা সিনেমার প্রখ্যাত অভিনেতা। উত্তম কুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ ছবিতে। শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গেও পর্দায় রোমান্স করেছেন এই অভিনেতা।
বরিশালের ছেলে মিঠুনকে বাংলাদেশের ছবিতেও অভিনয় করতে দেখা গেছে। যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘অবিচার’ এ অভিনয় করে বেশ আলোচিত হন তিনি। চিত্রনায়িকা রোজিনা ও নূতনের সঙ্গে তার অভিনয় সহজেই ঢাকাই সিনেমার দর্শকদের রাঙিয়েছে। ঢালিউডের প্রখ্যাত নির্মাতা আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন এই ফাটাকেষ্ট।
একটা সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা মিঠুন চক্রবর্তী তৃণমূলের রাজনীতিতে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। এরপর ২০১৪ সালে তাকে ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সংসদ সদস্যও (এমপি) করেছিলেন মমতা। কিন্তু হঠাৎ করেই সারদা কেলেঙ্কারিতে উঠে আসে মিঠুনের নাম। এর পরেই ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের জেরার সম্মুখীন হতে হয় মিঠুনকে। এ ঘটনার পরই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই অভিনেতা। চলে যান অন্তরালে। তৃণমূলের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
এরপর থেকে বাংলা ছেড়ে স্ত্রী সাবেক নায়িকা যোগিতা বালী ও সন্তানদের নিয়ে মুম্বাইয়ে বসবাস করছেন মিঠুন। সন্তানরাও চলচ্চিত্রে থিতু হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। মাঝে রিয়েলিটি শো এর বিচারক, উপস্থাপক হয়েছেন।
আবারও রাজনীতির ময়দানে ফিরেছেন মিঠুন চক্রবর্তী। তবে এবার আর তৃণমূলে নয়, নাম লিখিয়েছেন নরেন্দ্র মোদির বিজেপিতে। সম্প্রতি কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেড ময়দানে বিজেপির প্রচারাভিযান শুরু করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মোদির সমাবেশ শুরুর কিছুটা আগে বিজেপিতে যোগ দেন মিঠুন।
সাজেদ/