প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২২, ০৩:৫৬ এএম
বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র। সমাজের নানা চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি নানাবিধ বার্তা দেওয়া হয় চলচ্চিত্রে। বাংলাদেশে তৎকালীন (পূর্ব বাংলায়) ১৯ এর দশকে পূর্ব বাংলায় নির্বাক এবং ৫০ দশকে সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন শুরু হয়। ঢাকায় নির্মিত বাংলা ভাষায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৫৪ সালের ৬ই আগস্ট। মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। কীভাবে নির্মিত হলো ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র, কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, কত টাকা খরচ করতে হয়েছিল কিংবা নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী কারা ছিলেন সেই ইতিহাসই তুলে ধরা হলো সিটি নিউজ ঢাকা`র পাঠকদের জন্য-
বাংলা ভাষায় নির্মিত প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। যেটি নির্মাণ করেছিলেন আবদুল জব্বার খান। ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে এই চলচ্চিত্রে নায়ক হিসাবে অভিনয় করেন নির্মাতা নিজেই। নায়িকা ছিলেন পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী। এছাড়াও চিত্রগ্রাহক কিউ.এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক এফ. দোসানি পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। মূলত সেই মন্তব্যে ক্ষুদ্ধ হয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হন জব্বার খান। চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি শুরু করলেন অর্থ যোগানের চেষ্টা। কে দিবে এত টাকা? শেষ পর্যন্ত কী চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে? এমন সময় এগিয়ে এলেন সংস্কৃতিপ্রেমী কলিম উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া। যিনি ছবি নির্মাণের অর্ধেক খরচ দিয়েছিলেন। বাকি খরচ আব্দুল জব্বার খানের সঙ্গে তার চার বন্ধু দেন।
শেষ পর্যন্ত সহযোদ্ধাদের নিয়ে দোসানিকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার সময় এল। ১৯৫৪ সালের ৬ই আগস্ট, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জার উপস্থিতিতে হোটেল শাহবাগে অনুষ্ঠিত হলো ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের মহরত।
অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনে। তাও বিনা পারিশ্রমিকে। ঢাকার তেজগাঁও, কালীগঞ্জ, রাজারবাগ, কমলাপুর, লালমাটিয়া, সিদ্ধেশ্বরী, জিঞ্জিরা ও টঙ্গীতে করা হলো এর দৃশ্যধারণ।
শুটিং শেষে বড় চ্যালেঞ্জ ঢাকায় কোন প্রোডাকশন স্টুডিও না থাকা। চলচ্চিত্রটির এডিটিং করতে এর নেগেটিভ নিয়ে যাওয়া হয় লাহোরে। সেখানকার শাহনূর স্টুডিওতে ‘মুখ ও মুখোশ’বাকি কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৫৬। নির্মাণে প্রায় দুই বছর সময় লেগে গেল। আর জন্ম হল ঢাকায় নির্মিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র। এটি নির্মাণে খরচ হলো ওই সময়ের প্রায় ৮২ হাজার টাকা।
অর্থ জোগান, অভিজ্ঞতা ছাড়া অভিনয়, এছাড়া স্টুডিও না থাকায় বেশ চড়াই উতরাই পার করতে হল চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের। তবে চলচ্চিত্রটি মিললো না ঢাকায় ফেরার অনুমতি। বাধ্য হয়েই প্রথম প্রদর্শনী করতে হয় লাহোরে। এ যেন পদে পদে বিপদ। অবশেষে মিললো ঢাকায় আনার কাঙ্খিত অনুমতি।
এবার যেন ঘরের শত্রু বিভীষণ`। বাধা হয়ে দাঁড়ালো প্রদর্শকরা। আশানুরূপ সাড়া পেল না দেশের কোন হল মালিকেদর কাছ থেকে। তবে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে বেশিদিন লাগেনি। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট চলচ্চিত্রটি একযোগে প্রদর্শিত হয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং খুলনার উল্লাসিনী সিনেমা হলে। প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হলো রূপমহল প্রেক্ষাগৃহে। এর উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
৯৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের ‘মুখ ও মুখোশ’র গল্পে উঠে এল অসামাজিক কর্মকাণ্ড, পারিবারিক কলহ ও দুর্নীতির মতো বিষয়বন্তু। চলচ্চিত্রটি মুক্তির প্রথম দিকেই লগ্নিকৃত অর্থ উঠে আয় হলো ৪৮ হাজার টাকা। পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও টিভিতে সম্প্রচারে আয় হয় আরও কিছু অর্থ।
সাজেদ/