
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২, ১১:১৮ পিএম
মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নীলজলে ভাসমান ভাসানচর
চারদিকে সাগরের গর্জন। সাপের মতো ছোবল দিতে চায় নীল সাগরের জল। সেখানে একদিন মাছ-হাঙরের ডুব-সাঁতার ছিল। সেই জায়গাটি এখন হয়ে উঠেছে বন আর জনারণ্যের বিছানা। মাটি আর পানি কানাকানি করে। মুখে মুখ রেখে করে ভালোবাসা। এখন সেটি হয়ে উঠেছে ভাসানচর। আকাশের চাঁদ, নীলজল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। সেখানেই এখন গড়ে উঠেছে স্বপ্নের বসতভিটা।
নীলাভ সমুদ্রমাঝে লাখো মানুষের স্বপ্নের বসতভিটা হয়ে উঠেছে সুন্দরী ভাসানচর। আর এই চরের নামকরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি এখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ণ কেন্দ্র। নিজ দেশে বিতাড়িত মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশের এই সবুজ সীমানায়। এখানেই রোহিঙ্গাদের শয্যা হয়েছে বেঁচে থাকার ঠিকানা।
মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় বাংলাদেশের সীমানায় ১৪ বছর আগে জেগে ওঠে ছোট্ট একটি দ্বীপ। এর এক অংশের নাম ঠেঙ্গারচর। অপরটির নাম জালিয়ারচর। এই দুই অংশের নাম এখন ভাসানচর।
এটির মোট আয়তন ১৬ হাজার একর। এর মধ্যে ঠেঙ্গারচরের আয়তন ১০ হাজার এবং জালিয়ারচরের আয়তন ৬ হাজার একর। এখানে প্রায় ৬ হাজার ৪২৭ একর জমি ব্যবহারযোগ্য। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৭০২ একর জমি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ক্লাস্টার হাউস তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৪৩২ একর জমির ওপর।
ভাসানচরের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থ ৪.৫ কিলোমিটার। এটি হাতিয়া উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। নোয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার। উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচর উপজেলা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। দক্ষিণ-পূর্বে এবং চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
এ প্রকল্পের আওতায় ভূমি উন্নয়ন ও শোর প্রোটেকশন ওয়ার্ক, বাঁধ নির্মাণ, ১ লাখ ৩ হাজার ২০০ জনের বসবাসের জন্য ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ, উপাসনালয় নির্মাণ, দ্বীপটির নিরাপত্তার জন্য নৌবাহিনীর অফিস ভবন ও বাস ভবন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো, নলকূপ ও পানি সরবরাহ অবকাঠামো নির্মাণ, পেরিমিটার ফেন্সিং ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, বিভিন্ন যানবাহন ক্রয়, গুদামঘর, জ্বালানি ট্যাংক, হেলিপ্যাড, চ্যানেল মার্কিং ও মুরিং বয়, বোট ল্যান্ডিং সাইট, মোবাইল টাওয়ার, রাডার স্টেশন, সিসি টিভি, সোলার প্যানেল, জেনারেটর ও বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
নৌকায় চট্টগ্রাম থেকে ভাসানচর যেতে দুই ঘণ্টা লাগে। নোয়াখালী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। চারদিকে জল-বেষ্টিত এই দ্বীপটিতে পৌঁছলে বিদ্যুৎ ও সোলার প্যানেল, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং মোবাইল ফোনের টাওয়ারসহ ভবনগুলো যে কাউকে অবাক করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
এখানে রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য রয়েছে দুটি খেলার মাঠ। নামাজ, দাফন এবং বাজারের জন্যও রয়েছে জায়গা। সরকার, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন এনজিওর কর্মকর্তাদের জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে।
তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এ আবাসন প্রকল্প। মাটির চার ফুট ওপরে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি ভবনে রয়েছে ১৬টি কক্ষ। এসব কক্ষে স্টিলের খাট, আছে সিলিংফ্যান। এই ভবনের প্রতিটি ক্লাস্টারে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বিকল্প জলাধার রয়েছে।
এ ছাড়াও প্রতি ১২০টি কক্ষের জন্য পৃথক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে। এখানে যেকোনো জরুরি প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ১ হাজার মানুষ এবং ২০০ গবাদি পশু আশ্রয় নিতে পারবে। অন্যদিকে বন্যা মোকাবিলার জন্য ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। ভাসানচরে রয়েছে চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, দুটি ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, দুটি স্কুল, তিনটি মসজিদ, পণ্য সরবরাহ ও সংরক্ষণে চারটি গুদাম, বাজার, ৪৩ কিলোমিটার সড়ক এবং দুটি বড় হ্রদ।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় লেবু, নারকেল ও কেওড়াসহ প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন গাছ এই দ্বীপে লাগানো হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে লতাগুল্মের বনভূমি।
এখানে রয়েছে ৯০ মিটারের একটি বাতিঘর। বাতিঘরকে বেকন অব হোপ বা আশার আলোকবর্তিকাও বলা হয়। জরুরি অবস্থায় যোগাযোগের জন্য দ্বীপে দুটি হেলিপ্যাড রয়েছে। সবুজ করে গড়ে তোলা হয়েছে ভাসানচর। এখানে রাতে চাঁদের আলো মাটি আর পানির সঙ্গে কথা বলে। সকালে সূর্য-শুদ্ধ হাওয়া হাট বসে। মনে হয় প্রকৃতির সুন্দরগুলো যেন ক্রমান্বয়ে এখানে ঘর বাঁধছে। এই হলো ভাসানচর। বলা যায়, মানবপবনের চর।
সাজেদ/