প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২২, ১১:৪৬ পিএম
বিরিয়ানি-তেহারি যেটাই বলেন—পুরান ঢাকার নাম আসবেই। শত বছরের আগে থেকে এই খাবার শুধু ঢাকা নয়, সারা বিশ্বে পরিচিত। স্বাদ আর ঘ্রাণে আছে আলাদা এক বৈশিষ্ট্য। যদিও এখন হাজি বিরিয়ানি, মামা বিরিয়ানি—নানা নামে হচ্ছে। কিন্তু পুরান ঢাকার নাম কেউ ছেটে ফেলতে পারছে না। কারণ এখানে শুধু বিরিয়ানি নয়—আছে হাজার পদের মনকাড়া খাবার। তবে বিরিয়ানি-তেহারি সবার ওপরে।
পুরান ঢাকার বিরিয়ানি যেমন বিখ্যাত, তেমনি সমান জনপ্রিয় তেহারি। বিরিয়ানি ভারতবর্ষের সেরা খাবারের অন্যতম খাবার। পুরান ঢাকার বাসিন্দারা বলেন- ইংরেজরাও এটা খাবারের তালিকায় রাখতেন। বিরিয়ানির সুঘ্রাণ ক্ষুধা লাগিয়ে দেয়। এ খাবারে রয়েছে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য। বিরিয়ানির প্রকার প্রায় কয়েকশ’। কেবল এই ভারতবর্ষেই যে কত প্রকার বিরিয়ানি আছে, তা গুনে শেষ করা যাবে না। বিচিত্র সব বিরিয়ানির নাম। তবে এর মাঝে ঢাকাই, হায়দ্রাবাদি, সিন্ধি, লখনৌই, বোম্বাই, থালেশ্বরী, কোলকাতাই, মালাবারি ইত্যাদি বিরিয়ানি উল্লেখযোগ্য।
বিরিয়ানির স্বাদে যতই বিচিত্রতা থাকুক না কেন, রান্নার পদ্ধতিতে তেমন কোনো ফারাক নেই। বৈচিত্র্য লুকিয়ে আছে মসলার ব্যবহারে। বিরিয়ানির অতুলনীয় স্বাদের মূল কারণ হলো ‘দম’-এ রান্না হওয়া। আর সঙ্গে মসলার স্বাদ তো আছেই।
যে হাঁড়িতে বিরিয়ানি রান্না করা হয় তার ঢাকনাটা ময়দার তাল বা ডো (dough) দিয়ে আটকে দেয়া হয় যেন ভেতরের বাষ্প কোনোভাবেই বাইরে আসতে না পারে। অল্প আঁচে হাঁড়িটা বসিয়ে, ধীরে ধীরে বিরিয়ানিটা রান্না হওয়ার এই পদ্ধতিকেই ‘দম পোক্ত’ বা দমে রান্না হওয়া বলে। আর এই দমে রান্না হয় বলেই, সুগন্ধি চাল, ঘি, জাফরান, গোলাপজল, কেওড়াজল আর বিভিন্ন মসলার স্বাদ ও সুঘ্রাণ সব কিছুই মিশে হয়ে ওঠে অসাধারণ এক বিলাসী খাবার।
তবে, বাংলাদেশের বিরিয়ানি মানেই কাচ্চি বিরিয়ানি। পুরান ঢাকার মানুষের কাছে এই কাচ্চির সমাদরটা একটু বেশি। বিরিয়ানি মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে, কাচ্চি আর পাক্কি। কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নার সময়, হাঁড়িতে চাল ও কাঁচা আলুর ওপর টকদই ও মসলা মেখে রাখা কাঁচা মাংসের আস্তরণ দেয়া হয়। তারপর ভালো করে ঢাকনা চাপা দিয়ে দমে রান্না করা হয়। মূলত খাসি বা পাঁঠার মাংস দিয়েই কাচ্চিাটা রান্না হয়। মসলা মাখা মাংস, সুগন্ধি চাল, ঘি, জাফরান, গোলাপজল সবকিছুর স্বাদ ও সুঘ্রাণ একসঙ্গে হয়ে তৈরি হয় অতুলনীয় স্বাদের কাচ্চি।
ঢাকাই কাচ্চি বিরিয়ানি একটি ঐতিহ্যের নাম। নিঃসন্দেহেই এটি ঢাকা শহরের একটি ট্রেডমার্ক। মুঘলদের হাত ধরে যেসব মোগলাই খাবার ঢাকা শহরে এসেছে, তার মাঝে বিরিয়ানিই সেরা। ঢাকায় বিরিয়ানির কথা বললেই যে নামটি সবার আগে আসে তা হলো ‘হাজীর বিরিয়ানি’। ১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন সাহেবের হাত ধরেই শুরু হয় এ বিরিয়ানির পথচলা, যার কদর এখনও একটুও কমেনি।
হাজীর বিরিয়ানি থেকেই ঢাকায় শুরু হয় বিরিয়ানিশিল্প। ধীরে ধীরে ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি, চানখারপুলের হাজী নান্নার বিরিয়ানি, নারিন্দার ঝুনুর বিরিয়ানি হয়ে উঠে সেই শিল্পেরই অংশ। আর এখন কেবল নতুন ও পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকাই বিরিয়ানির জৌলুস ছড়িয়ে গেছে সুদূর প্রবাসেও।
অপর দিকে, তেহারি হচ্ছে বিরিয়ানিরই একটা পরিমার্জিত রূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চড়া দামের কারণে খরচ বাঁচাতে এই খাবারের উৎপত্তি হয়েছিল। তেহারি বিরিয়ানির চেয়ে অনেক মসলাদার এবং ঝাল হয়। তবে তেহারির বিশেষত্ব হলো এতে প্রচুর পরিমাণ গরুর মাংস এবং কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হয়। এটা মূলত এক ধরনের পাক্কি বিরিয়ানি। তেহারিতে গরুর মাংসের ছোট ছোট টুকরা ব্যবহার করা হয় আর বিরিয়ানির চেয়ে মাংসের পরিমাণটাও কিছু কম থাকে।
পুরান ঢাকার তেহারির বিশেষত্ব হলো- পুরো তেহারিটাই সরিষার তেলে রান্না করা হয়। যে কারণে সরিষার কড়া ঝাঁজ তেহারিকে করে তোলে অনন্য। পাক্কি বিরিয়ানি রান্নার ক্ষেত্রে, মাংসটাকে আলাদা কষিয়ে রান্না করা হয়। আর চালটাকে আগে থেকেই ঘিয়ে ভেজে আধা সেদ্ধ করে নেয়া হয়। এরপর একসঙ্গে মিশিয়ে দমে দিয়ে রান্না করা হয়। ঐতিহ্যবাহী হাজীর বিরিয়ানি, ফখরুদ্দিন বিরিয়ানি, হাজী নান্নার বিরিয়ানি, ঝুনুর বিরিয়ানিসহ পুরান ঢাকার অলিতে-গলিতে সর্বত্র পাওয়া যায়।
কাচ্চি বিরিয়ানির প্রসার যেমন ঘটেছে, তেমনি বেড়েছে এর চাহিদা। কাজেই ঢাকাই বিরিয়ানি ফেলে আসা কয়েকশ বছরের এ দীর্ঘ ইতহাস এবং বালাদেশের অহংকার।
সাজেদ/