প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২২, ১১:০৬ পিএম
জলবায়ু পরিবর্তন এবং অব্যাহত পরিবেশ দূষণে বহু প্রাণী প্রাণ হারিয়েছে। প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, গত কয়েক দশকে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে ১০ লাখের বেশি প্রজাতির প্রাণী। উদ্বেগের বিষয়, জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তির হারকে বাড়িয়ে তুলেছে মানুষের নেতিবাচক কার্যকলাপ। যে কারণে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি পরিমাণ প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।
অপরদিকে, ইন্টারনেটে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক ক্ষমতা ছোট ছোট প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় এখন সারা বিশ্বের প্রাণিকুল।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ প্রাণী বিলুপ্তির পেছনে প্রধানত মানবসভ্যতা দায়ী। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্তির পেছনে বিজ্ঞানীরা মানুষের ভূমিকাকে দায়ী করলেও প্রাকৃতিক কারণেও কমছে প্রাণী। জীববৈচিত্র্যের এই করুণ পরিণতির জন্য স্থানীয় নানা কারণও দায়ী। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
প্রাণীদের আবাসস্থল নিরাপদ নয়। গাছ কর্তন, বসতবাড়ি গড়ে তোলায় বনজঞ্জল কমে আসাও প্রাণী বিলুপ্তির বড় কারণ। সেই সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে পশুপাখির মৃত্যুকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই।
কিছুদিন আগে জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (আইপিবিইএস) একটি গবেষণা চালায়। তাতে ৫০টি দেশের ১৪৫ জন বিশেষজ্ঞ অংশ নিয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনের দাবি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেপরোয়াভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের ফলে বিপন্ন হচ্ছে লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণী। মানুষের নানাবিধ কার্যকলাপের কারণে বাড়ছে পৃথিবীর উষ্ণায়ন। প্রতিবছরই বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রজাতির প্রাণী, যা আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জলে বাস করে যে প্রাণীগুলো, তারাও খালবিলের অভাবে শুকনো স্থানে উঠে প্রাণ হারাচ্ছে। পুকুর কিংবা দীঘি-ডোবা না থাকায় জলজ প্রাণীদের এমনভাবে পৃথিবী থেকে ফুরিয়ে যাওয়া। তাই একদিকে প্রাণীদের বাসস্থান কমছে, অপরদিকে অপব্যবহার হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন এবং দূষণও বাড়ছে হু-হু করে। আর এসব কিছুর পেছনে রয়েছে শুধুই কিছু মানুষের ভূমিকা। মাটির ভেতরে যে প্রাণীগুলো বসবাস করে তারাও নিরাপত্তাজনিত কারণে ভুগছে। পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে, যে কারণে মাটির গর্তে যে প্রাণীর বসবাস-তারাও ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়ছে। অকালে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে মরে যাচ্ছে।
এই গ্রহের উদ্ভিদ এবং প্রাণী মিলে এক লাখেরও বেশি প্রজাতি খুব দ্রুত বিলুপ্তির পথে। এর তিন-চতুর্থাংশই মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম স্তন্যপায়ীদের মধ্যে গ্লার অন্যতম। এদের সর্বশেষ উপযুক্ত আবাসস্থল আফ্রিকা। অথচ আফ্রিকার অনেক দেশেই আজ বিলুপ্তির পথে গ্লার। চোরা শিকারিদের কারণে অনেক দেশ থেকেই আশঙ্কাজনক হারে কমছে গ্লার। অন্য এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী শতকে আফ্রিকার প্রায় অর্ধেক প্রজাতির পাখিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গত এক দশকে ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার স্থলভাগের ৪২ ভাগ প্রাণী এবং উদ্ভিদ কমে গেছে। আমাজন নদীতে তিন হাজার প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী রয়েছে। কিন্তু উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাজনসহ বিশ্বের বিভিন্ন নদ-নদী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মাছসহ অনেক জলজ প্রাণী।
বাংলাদেশের জলজ ও ছোট প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত ভালো থাকলেও বড় আকৃতির প্রাণীদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। গত পাঁচ দশকের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গন্ডার ও মহিষের বেশ কয়েকটি প্রজাতি এবং হরিণের কয়েকটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া পাখির মধ্যে বড় আকৃতির ময়ূরও এখন আর নেই। শিয়াল, খরগোশ, বেজি, উট ও পেঁচা কালেভদ্রে চোখে পড়ে। অস্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে চড়ই, বাবুই। দোয়েল, শ্যামা ঘুঘু, মাছরাঙা, বনমোরগ, কাঠবিড়ালি, গোছো ব্যাঙ, গেছো সাপসহ এমন অনেক প্রাণী।
গত ১০০ বছরে ১৫টি বন্যপ্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডোরাকাটা হায়েনা, ধূসর নেকড়ে, ধীরগতির ভাল্লুক, বারো শিংওয়ালা হরিণ, কৃষ্ণমৃগ, বুনো মহিষ, সুমাত্রার গন্ডার, জাভার গন্ডার, ভারতীয় গন্ডার, ভারতীয় ময়ূর, ডাহর ইত্যাদি। ১৯৩০ সালে গোলাপি মাথার হাঁস বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার এক দশকের মাথায় বিশ্ব থেকেও হারিয়ে গেছে সেটি।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের বৈশ্বিক বন্যপ্রাণীদের অবস্থাবিষয়ক প্রতিবেদন ‘রেড লিস্ট’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ১৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ১০ প্রজাতির পাখি ও ২ প্রজাতির উভচর প্রাণী মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়ে এখন হয়েছে ১৬৪। এর আগে ছিল ১১৪টি। এই হিসাব ২০২০-এর মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে আড়াইশ’ হাতি আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশই সফল হয়েছে। যেমন চীন পান্ডাকে বিলুপ্তির কাছাকাছি থেকে ফিরিয়ে এনেছে। দ্রুততার সঙ্গে প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হলেও তাদের সংরক্ষণের উদ্যোগ ততটা জরুরি ভিত্তিতে নেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থলগুলো নানা ধরনের শিল্পায়ন, মানুষের চাপসহ বিভিন্ন কারণে ধ্বংস ও দূষিত হয়ে উঠছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেরও যথেষ্ট পরিমাণে প্রয়োগ হচ্ছে না। প্রকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তাই গুরুত্ব বাড়াতে হবে। একইভাবে বাংলাদেশের প্রাণিকুলকে সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচাতে হবে। তাহলেই উভয়চর প্রাণীকে বাঁচানো সম্ভব।
সাজেদ/